মাধ্যমিক ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায় || সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথাঃ বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষন || ৪ নম্বরের প্শ্ন ও উত্তর
মাধ্যমিক ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায় ৪ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর |
প্রিয় মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা,
আজকে তোমাদের সঙ্গে শেয়ার করবো মাধ্যমিক ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায় || সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথাঃ বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষন || ৪ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর|Madhyamik History Question and Answer |10th History Examination – দশম শ্রেনীর চতুর্থ অধ্যায় সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথাঃ বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষন থেকে চতুর্থ অধ্যায় সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথাঃ বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষন ৪ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর পেয়ে যাবে|এছাড়াও তোমরা মাধ্যমিক চতুর্থ অধ্যায় ৪ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর|মাধ্যমিক চতুর্থ অধ্যায় ৪ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর |Ten History Examination - মাধ্যমিক চতুর্থ অধ্যায় ১ ও ২ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর|মাধ্যমিক চতুর্থ অধ্যায় ৮ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর|দশম শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর পেয়ে যাবে এগুলি তোমাদের ফাইনাল পরিক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন হবে।
তো বন্ধুরা সংঘব্ধতার গোড়ার কথা : বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ চতুর্থ অধ্যায় থেকে বহুবিকল্পভিত্তিক, সংক্ষিপ্ত, অতিসংক্ষিপ্ত এবং রোচনাধর্মী প্রশ্ন উত্তর (MCQ, Very Short, Short, Descriptive Question and Answer)|তোমাদের এই পোস্টের মাধ্যমে মাধ্যমিক ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায় সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথাঃ বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষন ৪ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর সম্পর্কে আলোচনা করা আছে। আমাদের আশা এই প্রশ্নগুলি তোমাদের পরিক্ষায় খুবই কাজে আসবে।
মাধ্যমিক ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায় || সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথাঃ বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষন || ৪ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর
1. 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলা হয় কেন?
ভূমিকাঃ-1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ইতিহাসে সিপাহি বিদ্রোহ, মহাবিদ্রোহ, ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রভৃতি বিভিন্ন নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক এ ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ যুক্তি সহকারে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সিপাহি বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিকের মতামত বিশ্লেষণ করলে যে দৃষ্টিকোণগুলি সামনে আসে তার মধ্যে একটি অন্যতম হল 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলা হয়।
জাতীয় বিদ্রোহ বলার কারন
এই বিদ্রোহকে নিছক সিপাহী বিদ্রোহ হিসেবে আখ্যায়িত না করে অনেকেই সিপাহি বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলতে অধিক পছন্দ করেন। ঐতিহাসিক হোমস, ডাফ, ম্যালেসন,জে.বি, নর্টন, আউট্রাম এবং ডিসরেলি এই বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলেছেন। সমাজতন্ত্রবাদের জনক কার্ল মার্কসও একে ‘জাতীয় বিদ্রোহ’ বলে উল্লেখ করেছেন।
সিপাহি বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলার যুক্তিগুলি হল-
a.এই বিদ্রোহ সিপাহিরা শুরু করলেও অচিরেই বিভিন্ন স্থানের অসামরিক ব্যক্তিবর্গ এতে যোগ দিয়েছিল।
b.বিদ্রোহীরা সিংহাসনচ্যুত শেষ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে সম্রাট বলে ঘোষণা করে বিদ্রোহে ঝাপিয়ে পড়েছিল।
c.রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয়তাবোধের সঙ্গে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য মিশে জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়। সেদিক থেকে সিপাহি বিদ্রোহে প্রায় সমগ্র ভারতবাসী ব্রিটিশ শোষণ থেকে ভারতকে মুক্ত করার জন্য যোগ দিয়েছিল । তাই একে জাতীয় বিদ্রোহ বলাই যুক্তিযুক্ত তাই একে সিপাহি বিদ্রোহ না বলাই শ্রেয়।
2. 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বলার কারন কী?
ভূমিকাঃ- 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ইতিহাসে সিপাহি বিদ্রোহ, মহাবিদ্রোহ, ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রভৃতি বিভিন্ন নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক এ ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ যুক্তি সহকারে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। বিনায়ক দামোদর সাভারকার তার Indian War of Independence গ্রন্থের সিপাহী বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে উল্লেখ করেছেন।
পক্ষে যুক্তিঃ-
a. ইংরেজ কোম্পানির দীর্ঘকালের শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ ছিল ভারতবর্ষের বুকে জনগণের জ্বলন্ত প্রতিবাদ।
b. বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটাতে চেয়েছিল।
c.1857-সালের বিদ্রোহ সমগ্র ভারতে না হলেও এমনকি এর কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য না থাকলেও অধিকাংশ ভারতীয়ই মনেপ্রাণে ইংরেজদের বিতাড়ন চেয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক এক সঙ্গে লড়েছিল এবং দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট করেছিল।
d. ইংরেজ-বিরোধী এত ব্যাপক আন্দোলন ভারতে আর হয়নি। তাই গতানুগতিক বিচার না করে এই অভূখানকে স্বাধীনতার সংগ্রাম বলাই যুক্তিযুক্ত।
উপসংহারঃ- এই বিদ্রোহকে নিছক সিপাহি বিদ্রোহ,সামন্ত বিদ্রোহ বা সনাতনপন্থীদের বিদ্রোহ কিংবা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করা ঠিক হবে না, আবার কেবল ধর্মীয় কারণ বা এনফিল্ড রাইফেলের টোটার জন্যই এই বিদ্রোহ সংঘটিত হয়নি। এই বিদ্রোহ হল মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই ছিল সাধারণ মানুষ। বাহাদুর শাহ,নানাসাহেব, লক্ষ্মীবাঈ প্রমুখ নেতৃবৃন্দকে তারা বিদ্রোহে যোগ দিতে বাধ্য করে। নানা ত্রুটি, নানা গোলযোগ, নানা বিদ্বেষ সত্ত্বেও এই বিদ্রোহের গণ-চরিত্রকে কখনই অস্বীকার করা যায় না বা একে স্বাধীনতা সংগ্রাম বললেও অত্যুক্তি হয় না। যাইহোক এই বিদ্রোহকে কোনো বিশেষ একটি মত দিয়ে বিশ্লেষণ করলে এর সঠিক চরিত্র বোঝা যাবে না,তাই কোনো একটি বিশেষ মত যেমন পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনি আবার ভিত্তিহীনও নয়। প্রত্যেক মতামতের পেছনে কিছু না কিছু সত্য লুকিয়ে আছে।
3. 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি সমাজের মনোভাব কি ছিল?
অথবা
1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় কেন সমর্থন করেননি?
ভূমিকাঃ- 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে সেই সময়ের শিক্ষিত বাঙালি সমাজ সমর্থন করেনি; উপরন্তু তারা বিদ্রোহী সিপাহিদের ও বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত নেতানেত্রীদের ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেছিল। শিক্ষিত বাঙালি সমাজ এই বিদ্রোহে বিদ্রোহীদের পরাজয় ও ব্রিটিশদের জয় কামনা করেছিল।
শিক্ষিত বাঙালি সমাজের বিরোধিতার কারণ:- শিক্ষিত বাঙালি সমাজ বিভিন্ন কারনে 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল। মধ্যযুগীয় শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার ভয়ে শিক্ষিত বাঙালি সমাজ মনে করেছিল বিদ্রোহীরা জয়লাভ করলে ভারতে আবার মধ্যযুগীয় মুঘল শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। তারা মধ্যযুগীয় মুঘল শাসনের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। শিক্ষিত বাঙালি সমাজ ছিল আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কারের সমর্থক। তারা মনে করেছিল বিদ্রোহীরা জয়ী হলে তাদের সামন্ততান্ত্রিক শাসনে আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কারের অবসান ঘটবে। আধুনিকতার অবসানের ভয়েও তারা সমর্থন করেননি।
বিরোধীতা:-
a. সভা করে বিরোধিতা করা:- বিদ্রোহ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাজা রাধাকান্ত দেবের সভাপতিত্বে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সভা হয়। সভায় বিদ্রোহীদের নিন্দা করা হয়।
b. মেট্রোপলিটন কলেজের সভা:-রাজা রাধাকান্ত দেবের সভাপতিত্বে বিদ্রোহবিরোধী আরও একটি সভা হয় মেট্রোপলিটন কলেজে (26শে মে, 1857 খ্রি.)। এই সভায় উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ হলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ, কমলকৃষ্ণ বাহাদুর, হরচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ। তারা সরকারকে সবরকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সভায় প্রস্তাব পাস করেন এবং সরকারের কাছে তা পেশ করেন।
c. পত্রপত্রিকায় বিরোধিতা:-সংবাদ ভাস্কর, সংবাদ প্রভাকর প্রভৃতি পত্রপত্রিকায় শিক্ষিত বাঙালি সমাজ বিদ্রোহীদের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন যে, ‘হে বিঘ্ন হর..... ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের জয়পতাকা চিরকাল সমভাবে উড্ডীয়মান কর। অত্যাচারি অপকারি বিদ্রোহকারি দুর্জনদিগকে সমুচিত প্রতিফল প্রদান কর।" এছাড়াও বিভিন্ন গ্রন্থ সমূহেও বাঙালি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় নানাভাবে বিরোধিতা করেছিল।
যাইহোক খুব শীঘ্রই বাঙালি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ভুল ভেঙে যায়, তাদের সামনে ব্রিটিশ সরকারের নগ্ন রূপ উন্মোচিত হয়। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকারের দমন মূলক কার্যকলাপ লক্ষ্য করে শিক্ষিত বাঙ্গালীদের ব্রিটিশ শাসনের প্রতি মোহ ভঙ্গ হয়েছিল এবং তারা জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী হয়েছিলেন।
4. 1857 সালের সালের বিদ্রোহকে কেন সামন্ত শ্রেণীর বিদ্রোহ বলা হয়?
অথবা
1857 সালের সালের বিদ্রোহকে কেন সামন্ত শ্রেণীর বিদ্রোহ বলা যায়না ?
সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া: বিভিন্ন তথ্যসংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে কিছু ঐতিহাসিক বলেছেন, 1857 খ্রিস্টাব্দের ঘটনা ছিল সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া বা সনাতনপন্থীদের বিদ্রোহ। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন, রজনীপাম দত্ত প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ এ বিষয়ে একমত। লর্ড ডালহৌসির স্বত্ববিলোপ নীতির ফলে ঝাসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, পেশওয়ার দত্তকপুত্র নানাসাহেব তাঁদের রাজ্য হারান,সাতারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়, কুশাসনের অজুহাতে অযোধ্যা রাজ্য ইংরেজরা দখল করে। নতুন ভূমিব্যবস্থায় এখানকার তালুকদাররা জমি হারায়। ফলে রাজ্যহারা রাজা-রানি, জমি হারা কৃষক,জমিদার তালুকদাররা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং তারা ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহে অংশ নেয়।ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার-এর মতে, এই বিদ্রোহ ছিল ক্ষয়িষ্ণু অভিজাততন্ত্র ও মৃতপ্রায় সামন্তদের ‘মৃত্যুকালীন আর্তনাদ’।
অপরপক্ষে অধ্যাপক সুশোভন সরকার বলেন যে, নানাসাহেব, লক্ষ্মীবাঈ, হজরৎ মহল, কুনওয়ার সিং প্রমুখ। সামন্ত-জমিদার ও তালুকদারদের হাতে বিদ্রোহের নেতৃত্ব ছিল বলে এই বিদ্রোহকে কখনই সামন্ত বিদ্রোহ ও প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দেওয়া যায় না। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতে সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাধারা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল এবং তারাই ছিলেন সমাজের ‘স্বাভাবিক নেতা। এই কারণে এই অভ্যুত্থানও সামন্ত-প্রভাবিত হওয়া স্বাভাবিক ছিল। তার মতে, অভ্যুত্থান জয়যুক্ত হলে তা রক্ষার জন্য সামন্ত-প্রভাব মুক্ত নতুন শক্তির, নতুন কৌশলের ও নতুন সংগঠনের আবির্ভাব ঘটত। তিনি বলেন যে, সামন্তব্যবস্থার স্তম্ভস্বরূপ রাজন্যবর্গের একজনও বিদ্রোহে যোগ দেননি এবং অযোধ্যার বাইরে জমিদারদের অধিকাংশই ছিলেন ইংরেজদের পক্ষে। বিদ্রোহে যোগদান করা দুরে থাক—প্রকৃত সামন্ত নেতৃবৃন্দ বিদ্রোহ বানচাল করতেই ব্যস্ত ছিলেন। সুতরাং এই বিদ্রোহকে কখনই সামন্ত বিদ্রোহ বলা যায় না।
যাইহোক ঐতিহাসিক পি. সি. যোশী নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে রুশ-সামন্ত, ইতালির ঐক্য আন্দোলনে মাৎসিনী, গ্যারিবল্ডি, ক্যাভুর ও ভিক্টর ইম্যানুয়েলের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলেন যে, বিভিন্ন দেশের ইতিহাসে সামন্তদের গৌরবজনক ভূমিকা থাকলেও ভারত ইতিহাসেও তাদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। তার মতে, সামন্ত-নেতৃত্বে পরিচালিত হলেও ১৮৫৭-র বিদ্রোহ প্রকৃতপক্ষে জাতীয় সংগ্রাম।
5. আনন্দমঠ উপন্যাসটি কিভাবে ভারতের জাতীয়তাবাদী চেতনা বিস্তারে সহায়তা করেছিল?
ভূমিকা:- পৃথিবীর যেকোন দেশে স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারা বিকাশের সঙ্গে সেই দেশের দেশাত্মবোধক ও জাতীয়তাবাদী সাহিত্যের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দেশাত্মবোধক সাহিত্যের বিকাশ ভারত ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যে সমস্ত মনীষীরা তাদের লেখার মাধ্যমে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ও প্রসার ঘটিয়েছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং তার লেখা দেশাত্মবোধক উপন্যাস ‘আনন্দমঠ'।
আনন্দমঠ উপন্যাসের রচনা ও প্রকাশ:
রচনাঃ- ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের রচয়িতা হলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
প্রকাশঃ- ‘আনন্দমঠ’ প্রথম প্রকাশিত হয় 1882 খ্রিস্টাব্দের 15 ডিসেম্বর।
আনন্দমঠ উপন্যাসের পটভূমিঃ- আনন্দমঠ উপন্যাসের পটভূমি হল অষ্টাদশ শতকের সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ও ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। আনন্দমঠে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মর্মস্পর্শী বর্ণনা আছে। এই উপন্যাসের মূল সুর হল দেশাত্মবোধ এবং পরাধীন মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য সন্তানদের প্রবল প্রচেষ্টা।
সন্তান দল:- বাংলায় মুসলিম রাজশক্তির পতন ও ইংরেজ রাজত্বের প্রতিষ্ঠা এক নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে। এই সংকটকালে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশমাতার মুক্তির জন্য সন্তান দলের আবির্ভাব ঘটে। ‘আনন্দমঠ’উপন্যাসের মূল চরিত্রই সন্তান দল। তাদের আদর্শ অনুসরণ করে দেশের যুবসমাজকে দেশমাতার পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনের জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানান বঙ্কিমচন্দ্র।
আনন্দমঠের মূল বিষয়:- আনন্দমঠ উপন্যাসে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একদল আত্মত্যাগী সন্ন্যাসীর কার্যাবলির বিবরণ আছে। এই উপন্যাসে সত্যানন্দের আহ্বানের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধ জাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আনন্দমঠ উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র পরাধীন দেশমাতার লাঞ্ছিত রূপ তুলে ধরেছেন। তিনি এই দেশমাতার উদ্ধারের জন্য আত্মবলিদানে প্রস্তুত একদল মাতৃভক্ত সন্তানের কথা বলে যুবসম্প্রদায়কে দেশপ্রেম ও সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন। আনন্দমঠের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতের চরমপন্থী ও বিপ্লবীরা দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করে তাকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করার কাজে ব্রতী হন।
বন্দেমাতরমঃ- বন্দেমাতরম গান ও স্লোগানটি আনন্দমঠ উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত। ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের প্রসারে বন্দেমাতরম-এর অবদান অপরিসীম। 1896 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বন্দেমাতরম গানটি গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছিলেন।
মূল্যায়নঃ- ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বিকাশে বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ ও তার বন্দেমাতরম গানটির অবদান অপরিসীম। অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত আনন্দমঠের স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্রকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ‘প্রকৃত জনক’ বলে অভিহিত করেছেন (The real father of Indian Nationalism)।
6. গগেন্দ্রনাথ ঠাকুর এর অঙ্কিত ব্যঙ্গচিত্র সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ- গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারেরএকজন সদস্য। তিনি বঙ্গীয় ঘরানার একজন চিত্রকর ও ব্যঙ্গচিত্রশিল্পী হিসেবে বিখ্যাত হয়ে আছেন। তাঁকে আধুনিক চিত্রশিল্পের পথিকৃৎ বলা হয়। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের
অঙ্কনশিক্ষাঃ- 1881 খ্রিস্টাব্দে 14 বছর বয়সে গগনেন্দ্রনাথের বাবা মারা যান। ফলে তার স্কুলশিক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তিনি নিজের ইচ্ছেমতো ছবি আঁকা শেখেন।
তিনি হরিনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে জলরঙে ছবি আঁকা ই শেখেন। পরে জাপানি শিল্পীদের দ্বারা (ওকাকুরা ও তাইকোয়ান) তিনি প্রভাবিত হন। তিনি তাঁর শিল্পে আধুনিকতাবাদী চিত্ররীতির পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন। শিল্প-সংস্কৃতির ঐতিহাসিক পার্থ মিত্রের মতে, 1940-এর দশকের আগে আমাদের দেশে গগনেন্দ্রনাথই ছিলেন একমাত্র শিল্পী যিনি পাশ্চাত্যের চিত্ররীতি কিউবিজম-এর ভাষা ও নির্মাণশৈলীকে তার ছবিতে কাজে লাগান। তবে তিনি কখনোই ইউরোপীয় রীতির অন্ধ অনুকরণ করেননি।
1.গগনেন্দ্রনাথের অঙ্কিত চিত্রঃ- গগনেন্দ্রনাথ তৎকালীন ভারতীয় ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায়ের ক্রিয়াকলাপ নিয়ে নানা ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কন করেন। তিনি চিত্রের মাধ্যমে সমাজের নানা বিষয় তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তিনি ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক সমাজের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তার ব্যঙ্গচিত্রগুলি—চৌষট হাজার, State Funeral of H.E. Old Bengal , অদ্ভুত লোক, ‘বিরূপ বর্জ’ এবং নব হুল্লোড় ইত্যাদি।
তাঁর ব্যঙ্গচিত্রগুলির মধ্যে প্রধান হল—
2.চৌষট হাজার—মন্ত্রীদের প্রাপ্য বেতন নিয়ে অঙ্কিত ব্যঙ্গচিত্র।
3.মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসনসংস্কারের সমালোচনা করে অঙ্কিত ব্যঙ্গচিত্র— State Funeral of H.E. Old Bengal
4.ঔপনিবেশিক ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অঙ্কিত ব্যঙ্গচিত্র। এতে তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে কলকারখানার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
5.বহু ভারতীয়ের মেকি দেশাত্মবোধকে ব্যঙ্গ করে অঙ্কিত চিত্র। গগনেন্দ্রনাথ তাঁর শিল্পকলার মাধ্যমে সমাজের নানান বিষয়কে তুলে ধরেছিলেন। প্রবাসী’ ও ‘মডার্ন রিভিয়ু’ -তে তাঁর ব্যঙ্গচিত্রগুলি ছাপা হত। শুধু বাংলার নয়, সমগ্র ভারতের ব্যঙ্গচিত্রের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ।
7. ভারত সভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ও কার্যকলাপ আলোচনা কর।
ভুমিকাঃ- সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ বুদ্ধিজীবী শ্রেণির নেতা উপলব্ধি করেছিলেন যে, দেশের বৃহত্তর জনগণের সংযোগে গণতান্ত্রিকভাবে সমিতি গঠন না করলে সরকার সেই সমিতির দাবিকে মূল্য দেবেন না প্রকৃতপক্ষে, আগেকার রাজনৈতিক সমিতিগুলি ছিল রক্ষণশীল ও তাদের আচরণ ছিল অভিজাতসুলভ। তা ছাড়া, সর্বভারতীয় স্তরে সমিতি গঠন ও আন্দোলন পরিচালনা না করলে সরকার আঞ্চলিক কোন সমিতির দাবিকে গুরুত্ব দেবে না। একথা বুঝতে পেরে 1876 খ্রিস্টাব্দের 26শে জুলাই কলকাতার অ্যালবার্ট হলে সুরেন্দ্রনাথ ও আরও কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর উদ্যোগে স্থাপিত হয় 'ভারতসভা বা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন'।
ভারতসভা’-র চারটি ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল,
(১)জনমত গঠন,
(২)ভারতের সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য স্থাপন,
(৩)হিন্দু-মুসলিম ঐক্য স্থাপন এবং
(৪)রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে ভারতের জনসংযোগ ঘটানো।
ভারত সভার কার্যাবলি: ভারতের জাতীয়তাবোধ বিকাশে ভারত সভা একাধিক আন্দোলন পরিচালনা করে।
a. ব্রিটিশ সরকার সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার বয়সসীমা 21থেকে কমিয়ে 19 করার ফলে ভারতীয় ছাত্ররা প্রতিযোগীগিতায় পিছিয়ে পড়তে থাকে। ভারত সভা এই আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। আইনের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের জন্য সুরেন্দ্রনাথ দেশব্যাপী ভ্রমণ করেন।
b. 1876 খ্রিস্টাব্দে লর্ড নর্থব্রুক নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন জারি করলে ভারত সভা এই আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
c. 1878 খ্রিস্টাব্দে লর্ড লিটন দেশীয় সংবাদপত্র এবং অস্ত্র আইন জারি করলে ভারত সভা দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু করে।
d. 1883 খ্রিস্টাব্দে বিচারব্যবস্থার ত্রুটি দূর করার নামে বৈষম্যমূলক ইলবার্ট বিল পাস করলে ভারত সভা প্রতিবাদ জানায় এবং আন্দোলন শুরু করে।
উপরিউক্ত ভারতসভা কর্তৃক দাবিদাওয়া গুলি পুরোপুরি সফল না হলেও এই সভা ভারতের রাজনৈতিক জাগরন অথা জাতীয়তাবাদের বিকাশে প্রভুত অবদান রেখে ছিল এবং জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পথ প্রদর্শকের কাজ করেছিল।
8. ভারতের জাতীয়তাবাদের বিকাশে ‘গোরা’ উপন্যাসের ভূমিকা কি ছিল?
অথবা
‘গোরা’ উপন্যাসের দিয়ে কীভাবে স্বদেশভাবনা বা জাতীয়তাবোধ ফুটে উঠেছে,তা লেখ।
অথবা,
জাতীয় চেতনা প্রসারে ‘গোরা' উপন্যাসের অবদান কী?
ভূমিকাঃ- যে সমস্ত উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব তাদের লেখা-লেখির মধ্যে দিয়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ জাগ্রত করার চেষ্টা করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তার রচীত ‘গোরা’ উপন্যাস। স্বাদেশকতার যুগে রচীত এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র গোরা, যাঁকে রবীন্দ্রনাথ একজন নির্ভেজাল দেশপ্রেমিক রূপে গড়ে তুলেছেন। ‘গোরা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেন্দ্রীয় চরিত্র গোরার বক্তব্য ও কার্যকলাপের মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে গঠনমূলক ও সমন্বয়বাদী জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন।
জাতীয়তাবোধের জাগরণঃ
প্রথমতঃ- গোরা উপন্যাসে গোয়ার চোখে দেশের অগণিত দরিদ্র মানুষের দুঃখকষ্ট ধরা পড়েছে। অশিক্ষিত মানুষের প্রতি এদেশীয় ইংরেজি জানা তথাকথিত শিক্ষিত ও ভদ্রবেশী মানুষের অবজ্ঞা ও বিদ্রুপ তাঁকে গভীরভাবে আহত করেছে।
দ্বিতীয়তঃ- নায়ক গোরার কাছে পার্থিব প্রেম-ভালোবাসা, দেশাত্মবোধের কাছে হার মেনেছে। তাই তিনি তাঁর প্রেমিকা
সুচরিতার প্রেমবন্ধন ছিন্ন করে দূরে সরে গিয়েছেন।
তৃতীয়তঃ- ব্রাত্মনেতা পরেশবাবুকে গোরা একদিন বলেছেন, ‘আপনি আমাকে আজ সেই দেবতার মন্ত্র দিন, যিনি হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-ব্রাক্ষ্মণ সকলেরই....যিনি ভারতবর্ষের দেবতা।' এই উক্তির মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন গোরার অন্তরে মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার নমুনা পাওয়া যায়, তেমনই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলার মনোভাবও সুস্পষ্ট হয়েছে।
চতুর্থতঃ- গোরা উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, ধর্মীয় সংকীর্ণতা জাতীয়তাবোধের পরিপন্থী। এর দ্বারা মানবগোষ্ঠী বা জাতির কোনো মঙ্গলসাধন হয় না। এজন্য তিনি গোরার মুখ দিয়ে তাঁর হিন্দু লালন-পালনকারি মা আনন্দময়ীর উদ্দেশ্যে বলিয়েছিলেন, “মা, তুমিই আমার মা... তোমার জাত নেই, বিচার নেই, ঘৃণা নেই ....তুমিই আমার ভারতবর্ষ।”
উপসংহার:- ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় সমাজ- সংস্কার আন্দোলন,পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার, বাংলা নবজাগরণের মতো ঘটনার মধ্যে দিয়ে পথ হাটছিল। সামাজিক টানাপোড়েন এই সময়ে বৈশিষ্ট্য সেখানে দাঁড়িয়ে রবীনাথ ঠাকুর অসাম্প্রদায়িকতার বাণী ছড়িয়ে দিয়ে জাতীয়তাবাদের মূল রূপ কি হতে পারে তা ভারতীয়দের সামনে তুলে ধরেন এ গোরা উপন্যাসের মাধ্যমে। এককথায় বলা যায় যে, ‘গোরা’ শুধুমাত্র একটি সাহিত্যই নয় এটি একটি দেশাত্মবোধক উপন্যাস।
9. ভারতমাতার চিত্র জাতীয়তাবাদের উন্মেষে কি ভূমিকা পালন করেছিল?
ভূমিকাঃ- ব্রিটিশ শাসিত পরাধীন ভারতবর্ষে চিত্রশিল্পীগণ চিত্রের মাধ্যমেও ভারতীয় জাতীয়তাবোধ ফুটিয়ে তোলlর চেষ্টা করেছিলেন। ভারতীয় জাতীয়তা বোধ সৃষ্টিকারী চিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কিত ‘ভারতমাতা’ চিত্রটি। জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতমাতা চিত্রটির মাধ্যমে বিশ শতকে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার ঘটান। তার অঙ্কিত চিত্রে ‘ভারতমাতা’ হলেন ভারতবর্ষের প্রতীক।
ভারতমাতার চিত্রকরঃ-‘ভারতমাতা’ চিত্রের চিত্রকর হলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ভারতমাতা চিত্রের অঙ্কন কালঃ- 1902 খ্রিস্টাব্দে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বঙ্গমাতা’ চিত্র অঙ্কন করেন। পরে ভারতের স্বদেশি আন্দোলনের আবহে 1905 খ্রিষ্টাব্দে তা ভারতমাতা রুপে খ্যাতি লাভ করে।
ভারতমাতার চিত্রের বর্ণনাঃ- ভারতমাতা হলেন গৈরিক বস্ত্র পরিহিতা এক দেবী। ভারতমাতার চারটি হাত। তিনি চারটি হাতে ধরে আছেন ধানের গোছা, সাদা কাপড়, বেদ ও জপমালা। তিনি সবুজ পৃথিবীর উপর দাঁড়িয়ে আছেন, তার পায়ের কাছে চারটি পদ্মফুল এবং পিছনে নীল আকাশ।।
ভারতমাতা ভারতবর্ষের প্রতীক। তিনি তার সন্তানদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও দীক্ষা প্রদান করেন। ভারতমাতা চিত্রটি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকালে জাতীয়তাবাদের প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে ‘ভারতমাতা’ চিত্রটি জনসাধারণের মধ্যে জাতীয়তাবোধের সঞ্চার করে।
ভগিনী নিবেদিতা ‘ভারতমাতা’-র ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন যে, এই চিত্রটির মাধ্যমে বিমূর্ত জাতীয়তাবাদকে মূর্ত করে তোলা হয়েছে।
10. মহারানীর ঘোষণাপত্রের ঐতিহাসিক তাৎপর্য কি?
অথবা
মহারানির ঘোষণাপত্র কী? মহারানির শাসনকালকে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অধ্যায়’ কেন বলা হয়?
অথবা
মহারানির ঘোষণাপত্র কী? মহারানির ঘোষণাপত্রের গুরুত্ব কী ছিল?
ভূমিকাঃ- মহাবিদ্রোহের পর ইংল্যাণ্ডের রাজনৈতিক মহল মনে করে যে, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির মতো একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের হাতে ভারতের মতো একটি বিশাল দেশের শাসনভার থাকা উচিত নয়। এই কারণে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১লা নভেম্বর এলাহাবাদে এক দরবারের আয়োজন করে মহারানী ভিক্টোরিয়া ভারতীয়দের কাছে কোম্পানির ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা এক ঘোষনা পত্রের মাধ্যমে পেশ করেন এই ঘটনা ইতিহাসে মহারানীর ঘোষণাপত্র বা Queen’s Proclamation নামে পরিচিত
এই ঘোষণাপত্রে বলা হয় যে,
a. ভারতবাসীর ধর্মীয় ও সামাজিক কোন ব্যাপারেই সরকার কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করবে না।
b. প্রত্যেক ভারতবাসী ধৰ্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবে।
c. জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যোগ্যতাসম্পন্ন সকল ভারতবাসীই সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত হতে পারবে।
d. স্বত্ববিলোপ নীতি বিলোপ করা হয়।
e. দেশীয় রাজন্যবর্গকে দত্তক গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়।
f. সরকার ভারতে আর সাম্রাজ্য বিস্তারে আগ্রহী নয়।
g. দেশীয় রাজ্যগুলিকে আশ্বস্ত করা হয় যে, কোম্পানির সঙ্গে স্বাক্ষরিত তাদের সব চুক্তি ও সন্ধিগুলিকে মেনে চলা হবে।
তাৎপর্য / সমালোচনাঃ- বলা বাহুল্য, মহারানির এইসব প্রতিশ্রুতি ঘোষণাপত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল ।
a. মহারানির ঘোষণাপত্রে ভারতীয় ও ইউরোপীয়দের প্রতি সমান আচরণ ও সমানাধিকারের কথা বলা হয়, এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ইংরেজরা নিজেদের ‘রাজার জাতি’ বলে মনে করত এবং ভারতীয়দের প্রতি তাদের আচরণ ছিল বিজেতা-সুলভ।
b. জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল প্রজার জন্য সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সমানাধিকার নীতি ঘোষণা করেও উচ্চপদস্থ চাকরিগুলির ক্ষেত্রে ভারতীয়দের প্রবেশাধিকার রুদ্ধ করে দেওয়া হয়।
c. ভারতীয়রা যাতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে এই উদ্দেশ্যে মহাবিদ্রোহের পরবর্তীকালে সরকার বিভেদ নীতি অবলম্বন করে। বিভিন্ন ধর্ম, সম্প্রদায়, জাতিগোষ্ঠী ও অঞ্চলের মানুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক করে তোলা হয়।
সুতরাং ভারতবাসীর সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে ইংরেজদের হস্তক্ষেপ মহাবিদ্রোহের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হলেও রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্য তারা জাতিভেদ ও সাম্প্রদায়িকতার বীজ ববন করতে থাকে।
তাই এই আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি যে, মহারানির ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত প্রতিশ্রুতিগুলি বেশির ভাগই ঘোষনাপত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই কারণে মহারানির শাসনকালকে অনেকে যেমন ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অধ্যায়’ (period of broken pledges) বলে চিহ্নিত করেছেন, বিপানচন্দ্রও এই ঘোষণাপত্রকে ‘রাজনৈতিক ধাপ্পা’ বলেছেন।
11. স্বামী বিবেকানন্দের ‘বর্তমান ভারত’ ভারতের জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ?
পৃথিবীর যেকোন দেশে স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারা বিকাশের সঙ্গে সেই দেশের দেশাত্মবোধক ও জাতীয়তাবাদী সাহিত্যের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দেশাত্মবোধক সাহিত্যের বিকাশ ভারত ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যে সমস্ত মনীষীরা তাদের লেখার মাধ্যমে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ও প্রসার ঘটিয়েছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন স্বামী বিবেকানন্দ এবং তার লেখা দেশাত্মবোধক উপন্যাস ‘বর্তমান ভারত'। স্বামী বিবেকানন্দের বর্তমান ভারত' গ্রন্থটি 1905 খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটিতে বিবেকানন্দের ভারত দর্শন এবং ভারত সম্পর্কে তাঁর দার্শনিক তত্ত তুলে ধরা হয়েছে যা জাতীয়তাবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে নতুন দিক খুলে দিয়েছ।
জাতীয় ঐতিহ্য: স্বামী বিবেকানন্দ এই গ্রন্থে প্রাচীন ভারতে বৈদিক ঋষিদের দ্বারা সমাজ শাসনকাল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ শাসনকাল পর্যন্ত ভারতের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, পাশ্চাত্যের প্রভাব থেকে ভারতবাসীর মুক্তির প্রয়োজন। কারণ জাতীয় ঐতিহ্য প্রকৃত জাতীয়তাবোধের উৎস।
সামাজিক মূল্যবোধ: বিবেকানন্দ বলেন, সমাজের উঁচুতলার মানুষের দ্বারা শত শত বছর ধরে শোষিত শূদ্র শ্রেণির মানুষ একসময় সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, তারা দেশ শাসন করবে। সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটবে এবং শুরু হবে প্রকৃত মানুষের ‘গণজাগরণ।
দেশপ্রেম: বিবেকানন্দের বর্তমান ভারত’ গ্রন্থে দেশপ্রেম জাগরিত হয়েছে। তিনি ভারতীয় সমাজকে ‘আমার শিশুশয্যা আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী’ বলে বর্ণনা করে প্রত্যেক ভারতবাসীকে সংঘবদ্ধ হতে বলেছেন।
জাতীয়তাবাদের বাণী: পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ ছেড়ে বিবেকানন্দ দেশমাতৃকার মুক্তির ডাক দিয়েছেন। তিনি ‘বর্তমান ভারত’-এ উল্লেখ করেছেন যে, মানুষ জন্ম থেকেই মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত।
পরিশেষে বলা যায়, বর্তমান ভারত’-এ বিবেকানন্দ ভারত ও ভারতবাসীর দুর্বলতাগুলিকে চিহ্নিত করে ও দুর্বলতা কাটিয়ে জাতীয়তাবাদের মহামন্ত্র ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।তাই ঐতিহাসিক আর. জি. প্রধান বিবেকানন্দকে ভারতের জাতীয়তবাদের জনক’ বলে অভিহিত করেছেন।
আরও পড়ুন......
- বন্ধুরা ২০২২ সালের অধ্যায় ভিত্তিক ইতিহাস সাজেশন এর জন্য Click Here
File Details |
|
File Name/Book Name | মাধ্যমিক ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায় ৪ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর |
File Format | PDF |
File Language | Bengali |
File Size | 213 KB |
File Location | GOOGLE DRIVE |
Download Link | Click Here to Download PDF File |