চার্লি চ্যাপলিন এর জীবনী(১৮৮৯- ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দ)
চার্লি
চ্যাপলিন
ভূমিকাঃ- শিল্প-সংস্কৃতির এক বিশেষ ধারা হাস্যকৌতুক-দর্শক
এবং শ্রোতাকে নির্মল আনন্দদানই যার লক্ষ্য। বিষয়টি হালকা মনে হলেও কিন্তু সহজ নয়।
অনেক হাসির খােরাক হয় বটে, কিন্তু মানুষ হাসিয়ে আনন্দদানের ব্যাপারটি আয়ত্ত করতে
পারে এমন লােকের সংখ্যা খুব কম। কিন্তু এই অসাধ্য কাজটি যিনি অনায়াসে সাধন করতে পেরেছিলেন
তিনি ছিলেন হাসির রাজা স্যার চার্লি চ্যাপলিন-যার নাম শুনলেই বিশ্বজুড়ে সবার চোখের
সামনে ভেসে ওঠে একটি হাস্যকৌতুকপূর্ণ মুখের ছবি, যাকে দেখামাত্রই শিশু-কিশাের যুবা-বৃদ্ধ
সবাই এমনিতেই হাসিতে আপ্লুত কৌতুকাভিনয় বলে একটি বিশেষ ধারা গড়ে উঠেছে ।
পরিবার
পরিচয়ঃ- কৌতুক, হাসি,
তামাশা, ঠাট্টা, ইয়ার্কি ইত্যাদির একটি বিশেষ ধরনই আধুনিক কৌতুক। আর এই বিশেষ ধারাটি
যাঁর দক্ষ হাতের স্পর্শে পুর্ণাঙ্গ বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে তিনি হলেন কৌতুকাভিনেতা চার্লি
চ্যাপলিন। চার্লি চ্যাপলিনের অসিল নাম ছিলাে চার্লস স্পেনসার। চ্যাপলিনের পিতার নামও
ছিলো চার্লস চ্যাপলিন। মায়ের নাম ছিল লিলি হার্নি। পিতামাতা দু’জনেই ছিলেন অতি সাধারণ
পরিবারের সন্তান। ভবঘুরে যাত্রাদলের নর্তক- নর্তকী। মা লিলি হার্নি গান গাইতেন আর নাচতেন।
আর চার্লস বাদ্য বাজাতেন আর মাঝে মধ্যে অভিনয় করতেন। লিলি হার্নির একবার বিয়ে হয়েছিল
জনৈক বড়লােকের সাথে। কিন্তু এ বিয়ে টেকেনি। যাত্রাদল থেকেই এক বড়লােকের সাথে ভাব
করে বিয়ে বসেছিলেন লিলি। তিন বছর পর এই বিয়ে ভেঙে গেলে লিলি আবার এসে জুটেছিলেন আগের
দলে। তখনাে চার্লস সে দলেই কাজ করতেন। দু'জনের সাথে আগেই পরিচয় ছিলাে। এবার সম্পর্ক
আরাে ঘনিষ্ঠ হলাে। তারপর বিয়ে আর তাঁদের সংসারেই জনা হলো বিশ্বখ্যাত কৌতুকাভিনেতা
চার্লি চ্যাপলিনের। স্বামী-স্ত্রী দু'জনে যাত্রাদলে নেচে আর গান গেয়ে সমান্য আয় করতেন।
তা দিয়ে তাদের সংসার চলতাে না ঠিকমতাে। সব সময় অভাব-অনটন লেগেই থাকতাে। এছাড়া চ্যাপলিনের
বাবা চার্লসের স্বভাবও খুব ভালাে ছিলাে না। ছিলাে নেশা করার অভ্যাস। সামান্য যা আয়
করতেন তার বেশিরভাগই খরচ করতেন নেশা করে। অতঃপর লিলি হানির দ্বিতীয় বিয়েও টিকলাে
না। নেশাখাের স্বামীর ঘর করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হলাে না। চার্লির জন্মের কয়েক বছর পরেই
তাঁদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো। মা লিলি ছেলে চ্যাপলিনকে নিয়েই রয়ে গেলেন যাত্রাদলে।
বাবা চলে গেলেন অন্যত্র। মায়ের দেখাদেখি ছােটবেলা থেকেই গানের এবং অভিনয়ের চর্চা
করতেন চ্যাপলিন। তাঁর গলার সুর ছিলাে ভারি চমৎকার। মা যেখানেই যেতেন ছেলে তার সাথে
থাকতেন । মা যতক্ষণ স্টেজে গান গাইতেন বা নাচতেন, চ্যাপলিন পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে
দেখতেন। সর্বক্ষণ নজর থাকতাে মায়ের উপর। হঠাৎ একদিন তার মায়ের অনুষ্ঠানে ঘটলাে এক
অঘটন।
কর্মজীবনের সূচনাঃ-
সেটা ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের কথা। মা স্টেজে গান গাইতে উঠেছেন। তাঁর শরীরটা দু'দিন থেকেই
খারাপ ছিলাে। পয়সার অভাবে অসুস্থ শরীর নিয়েও গান গাইতে এসেছিলেন। ফলে যা হবার তাই
হলাে। স্টেজে গান গাইতে গাইতেই মায়ের গলার আওয়াজ বের হলাে । ওদিকে দর্শকের গ্যালারি
থেকে শুরু হলাে হই হল্লোড়-চিকার। মা নিজের অবস্থা এবং স্টেজের হইচই দেখে আরাে ঘাবড়ে
গেলেন। পরে ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় তিনি পালিয়ে এলেন স্টেজ থেকে। পাশে দাঁড়িয়ে সব
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করছিলেন বালক চ্যাপলিন। যখন মা স্টেজ থেকে বের হয়ে এলেন তখনই
চ্যাপলিন এক অবাক কান্ড করে বসলেন। তিনি গিয়ে সােজা দাঁড়ালেন স্টেজে দর্শকের সামনে।
তারপর ধরলেন গান ও Jack Jones well and, known to everybody.
তার চমৎকার গলা শুনে
দর্শকরা তাে থমকে গেলাে। মুহূর্তে থেমে গেলাে গােলমাল ! এবার দর্শকরা আনন্দে উৎফুল্ল
হয়ে উঠলাে এবং সেই সাথে টাকা আধুলি সমানে এসে ছিটকে পড়তে লাগলাে স্টেজে। বৃষ্টির
মতাে । সবাই তার গানে খুশি। তবে এরই মধ্যে আরেক মজার কাণ্ড করে বসলেন চ্যাপলিন। যখন
দেখলেন বৃষ্টির মতাে তার চারপাশে টাকাপয়সা এসে ছিটকে পড়ছে অমনি গান থামিয়ে দর্শকদের
লক্ষ্য করে বলতে লাগলেন-আমি এখন আর গান গাইব না। আগে পয়সাগুলাে কুড়িয়ে নিই, তারপর
আবার গাইবাে। চ্যাপলিন এমন বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে কথাগুলাে বললেন যে দর্শকরা একটুও
রাগ না করে বরং আরাে মজা করে হাসতে লাগলাে। এবং আরাে পয়সা পড়তে লাগলো। চ্যাপলিনও
নানা অঙ্গভঙ্গি করে করে স্টেজের পয়সা কুড়াতে লাগলেন। সব পয়সা সংগ্রহ শেষ হলে স্টেজের
বাইরে দাঁড়ানাে মায়ের হাতে তুলে দিয়ে এসে আবার নতুন করে গান ধরলেন চ্যাপলিন। শুধু
দর্শকবৃন্দ নয়, সেদিন মা নিজেও ছেলের প্রতিভা দেখে বিস্মিত হয়ে ভাবছিলেন, হয়তােবা
ভবিষ্যতে তাঁর ছেলে বিস্ময়কর কিছু একটা হবে। মায়ের আশা পূর্ণ হয়েছিলাে চ্যাপলিনের
জীবন প্রতিষ্ঠায় ! চার্লি চ্যাপলিন প্রথম জীবনে অনেক দুঃখকষ্ট সহ্য করছেন। তার কিশাের-জীবন
কাটে মুদি দোকানে, ছাপাখানায়, রাস্তায় কাগজ বেঁচে, ঔষদের দোকানে এবং লােকের বাড়িতে
কাজ করে। চার্লি চ্যাপলিন ছিলেন তার সময়কার সবচেয়ে আলােচিত ও প্রশংসিত চলচ্চিত্র
ব্যক্তিত্বের একজন। বিশ্বের কোটি কোটি দর্শক আজো তার অপূর্ব অভিনয়দক্ষতা দেখে মুগ্ধ
হন-প্রশংসায় হন পঞ্চমুখ। চিত্রসমালােচকদের মতে চার্লি চ্যাপলিন তার সময়কার নির্বাক
চলচ্চিত্রকে একটি উন্নত শিল্পে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
জন্ম
পরিচয়ঃ- এই কৌশলী
অভিনেতার জন্ম হয়েছিলাে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল ইংল্যান্ডে। মাত্র ১১ বছর বয়সে
তিনি জন্মভূমি ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে আসেন আমেরিকায়। এখানে এসে তিনি জড়িয়ে পড়েন চলচ্চিত্র
জগতের সাথে। প্রবেশ করেন হলিউডে। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে কিস্টোন স্টুডিওতে চ্যাপলিন একটি
কমেডি ছবিতে অভিনয় করার সুযােগ লাভ করেন। তবে এখানে তিনি ছিলেন অন্যান্য সাধারণ অভিনেতাদের
মধ্যে একজন। তাঁর ভূমিকা সম্পর্কেও তিনি ছিলেন অনিশ্চিত। কিন্তু দ্বিতীয় ছবি ' কিড
আটোরেসেস অ্যাট ভােনস' ছবিতে অভিনয় করেই চার্লি তাঁর নিজস্ব ভঙ্গি প্রদর্শন করতে সক্ষম
হন। এই ছবিতে অভিনয় করার সময় তিনি প্রযােজকের পােশাক-পরিচ্ছদেও কৌতুক আনার চেষ্টা
করেন এবং সেজন্য বিশেষ অদ্ভুত ধরনের ব্যাগের মততা, প্যান্ট, বিরাট জুতাে পরিধান করেছিলেন।
আর সেই সাথে লাগিয়েছিলেন একটি নকল গোঁফ-এভাবেই তৈরি হয় লিটল ট্রাম্প।' চলচ্চিত্র
জগতে চ্যাপলিন নিজেই নিজের ভাগ্যকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য সফল করতে
সক্ষমও হয়েছিলেন। তাঁর দক্ষতা, বিপুল জনপ্রিয়তা একদিকে সৃজনশীল প্রতিভা এবং অনদিকে
অর্থের দ্বার-দুটোই খুলে দিয়েছিলাে।
কর্মজীবনঃ-
প্রথম প্রযােজক ম্যাকসিনট ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দেই যুবক
চ্যাপলিনকে দিয়েছিলেন ছবি পরিচালনার গুরু দায়িত্ব আর পারিশ্রমিক দিয়েছিলেন সপ্তাহে
১৫০ ডলার করে। এক বছর সময়ের মধ্যে তিনি ৩৫টি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি নির্মাণ করেন। এর পরের
বছর এখানে ছবি তৈরি করার জন্য তাকে সপ্তাহে ১২০০ ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তারও
বছর দেড়েক পর, মিউচ্যুয়াল ফিল্ম করপােরেশন' তাঁকে সপ্তাহে ১২,৮৪৪ ডলার করে দেয় এবং
বােনাস হিসেবে দেয় দেড় লাখ ডলার। এরপর আরাে উন্নতি হয় তাঁর। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে তিনি
প্রদর্শক সার্কিটের সাথে ১০,০০,০০০ ডলারের এক চুক্তি করেন। এরপরে বছরই (১৯১৮) তিনি
হলিউডে গড়ে তােলেন নিজস্ব চলচ্চিত্র স্টুডিও। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর সমসাময়িক
আরাে দু’জন তারকা ডগলাস ফায়ারবাংক এবং মেরি পিকফোর্ডকে নিয়ে গঠন করেন ইউনাইটেড আর্টিস্টস।
চার্লি চ্যাপলিনের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনী
হলাে দ্যা কিড।' ছবিটি নির্মিত হয়েছিলাে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে এবং এতে তার সাথে ছিলেন
শিশু অভিনেতা জ্যাকি কুগানে। ছবিটি প্রদর্শিত হবার সাথে সাথেই এটি মাস্টারপিস ছবি হিসেবে
প্রশংসিত হয়। এই ছবিতে তিনি শিল্পকর্মে ডিফেন্সীর আবেগপ্রবণতা ও দুঃখ ফুটিয়ে তােলার
সুযােগ লাভ করেন। ছবিটির পরিচালক হিসেবে চ্যাপলিনের বিচক্ষণতাও পরম বিশুদ্ধতা প্রমাণিত
হয়। দ্যা কিড’ ছবিতে ট্রাম্প রাস্তার পরিত্যক্ত একটি শিশুকে আশ্রয় দেয়। গােটা শিল্পীজীবনেই
চ্যাপলিন ছিলেন পরম বিশুদ্ধতার প্রয়াসী। হাজার হাজার ফুট ছবি তুলে তার মধ্যে কেবল
কয়েকশাে ফুট তাঁর কাছে বিবেচিত হতাে। যেমন ‘দ্যা কিড' ছবিতে ব্যবহৃত প্রতি ফুট কিলের
জন্য তুলেছেন ৫৩ ফুট ছবি, যা বর্তমান সময়ের জন্য একটি বিস্ময়কর অপচয়বিশেষ। চলতি
শতাব্দীর গােড়ার দিকে সােনার সন্ধানে আলস্কা অভিমূখে মানুষের ছুটে চলা সম্পর্কে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত দ্যা গােল্ড রাশ' ছবিটি
কতিপয় সমালােচকের মতে চ্যাপলিনের সবচেয়ে সফল কমিডি ছবি। এই ছবির একটি বিখ্যাত
দৃশ্যে ক্ষুধার্ত চ্যাপলিন খাদ্যভােজনের আয়েসে নিজের জুতাে সেদ্ধ করে খান। সবাক চলচ্চিত্র
আগমনের সাথে সাথেই কিন্তু চ্যাপলিন সেদিকে ঝুঁকে পড়েননি। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত নাৎসীবাদ নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক ছায়াছবি 'দ্যা গ্রেট
ডিক্টেটর’ ছিলাে তাঁর প্রথম সবাক ছায়াছবি ।
এ ছবিতেই তিনি ট্রাম্প
ভূমিকায় শেষ অভিনয় করেন। তিনি মনে করতেন মূকাভিনয়ের মাধ্যমেই একটি চরিত্রকে যথাযথভাবে
ফুটিয়ে তােলা যায়। চ্যাপলিন বিশ্বশান্তির জন্য আবেগময় আবেদন জানিয়ে দ্যা গ্রেট
ডিক্টেটর' -এর শৈল্পিক দিককে ক্ষুন্ন করলেও এটি একটি মাস্টারপিস ছবি হিসাবে ব্যাপকভাবে
বিবেচিত। দ্যা গ্রেট ডিক্টেটর' ছবিতে চ্যাপলিন সবাক চিত্র মাধ্যমকে ব্যবহার করে হিটলারের
মানসিকতাকে চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর পরবর্তী ছায়াছবি ‘মশিয়ে ভার্দু ফিলাে'
বিয়ােগাত্মক এবং লাইমলাইট' ছিলাে আবেগধর্মী ।
শেষ
জীবনঃ- চ্যাপলিনের
ব্যক্তিজীবনও খুব সুশৃঙ্খল ছিলাে না। তবে তিনি ব্যাপক প্রচার পেয়ে এসেছিলেন। সুইজারল্যান্ডেই
অবশেষে বিশ্বের কোটি কোটি দর্শকের প্রিয় অভিনেতা হাসির সম্রাট চার্লি চ্যাপলিন প্রায়
নিঃসঙ্গ অবস্থায় ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে ২৫ ডিসেম্বর পরলােকগমন করেন। চার্লি চ্যাপলিন আমাদের
মধ্যে না থাকলেও বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মনে এক বিশাল শিল্পীর ক্যানভাস হিসেবেই
বেঁচে আছেন।