রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর জীবনী (১৮৬১-১৯৪১)
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)
জন্ম
ও পরিচয়ঃ- দ্বারকানাথের
পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন ব্রাহ্মণধর্মে দীক্ষিত। উপনিষদের সুমহান আদর্শে নিজেকে গড়ে
তুলেছিলেন। তার স্ত্রী সারদা দেবী ছিলেন পনেরােটি সন্তানের জননী। রবীন্দ্রনাথ তাঁর
চতুর্দশ সন্তান। তার জন্ম হয় ঠাকুর বাড়িতে ২৫শে বৈশাখ, ১২৬৮। ঠাকুর বাড়ি ছিল সেই
যুগে সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, সংগীতের পীঠস্থান। দেবেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠপুত্র
দ্বিজেন্দ্রনাথ, মধ্যম সত্যেন্দ্রনাথ, পরবর্তী সন্তান হেমেন্দ্রনাথ, জ্যোতিন্দ্রনাথ
সকলেই ছিলেন প্রতিভাবনা। রবীন্দ্রনাথের জীবনে এই চার ভাইয়ের প্রভাব পড়েছিল খুব বেশি।
শিশু রবীন্দ্রনাথের জীবন কেটেছিল নিতান্তই সরল সাদাসিদে ভাবে ঝি-চাকরদের হেফাজতে।
পড়াশোনা
জীবনঃ- একটু বড় হতেই
প্রথমে ভর্তি হলেন ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে। অল্প কিছুদিন পর সেখান থেকে গেলেন নর্মাল
স্কুলে। বাড়িতে ছেলেদের সর্ববিদ্যা পারদর্শী করবার জন্য বিচিত্র শিক্ষার আয়ােজন করা
হয়েছিল। ভােরবেলায় পালােয়ানের কাছে কুস্তি শেখা, তারপর গৃহশিক্ষকের কাছে বাংলা,
অঙ্ক, ভূগােল, ইতিহাস পড়া। তারপর স্কুল ছুটির পর ইংরেজি পড়া, ছবি আঁকা, জিমনাস্টিক।
রবিবার সকালে বিজ্ঞান পড়া। রুটিন বাধা জীবনে শিশু মন হাঁপিয়ে ওঠে। এগারাে বছর বয়েসে
প্রথম মুক্তির স্বাদ পেলেন রবীন্দ্রনাথ। পিতা দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে গেলেন
১৮৭৩ সালে। বােলপুর তখন নিতান্তই এক গ্রাম। সেই প্রথম প্রকৃতির সাথে পরিচয় হল। এখানেই
বালক কবির কাব্য রচনায় সূত্রপাত। বােলপুর থেকে হিমালয়। চার মাস পশ্চিমের ভ্রমণ শেষ
করে কলকাতায় ফিরে এলেন রবীন্দ্রনাথ। স্কুল ভাল লাগে না। বাড়িতেই শিক্ষক স্থির হল।
পড়াশুনা আর কবিতা লেখা। তেরাে বৎসর আট মাস বয়েসে অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রথম স্বনামে
কবিতা ছাপা হল, “হিন্দুমেলার উপহার”। ষােল
১২৮৪ সালে দ্বিজেন্দ্রনাথের
সম্পাদনায় ভারতী পত্রিকা বের হল। নিয়মিত লিখে চলেন রবীন্দ্রনাথ। বছর বয়েসে লিখলেন
ভানুসিংহের পদাবলী। ধীরে ধীরে কৈশাের উত্তীর্ণ হন রবীন্দ্রনাথ। অভিভাবকদের সমস্ত প্রচেষ্টা
সত্ত্বেও স্কুলের গণ্ডি উত্তীর্ণ হতে পারলেন না। স্থির হল বিলেতে গিয়ে ব্যারিস্টার
হবেন। মেজভাই সত্যেন্দ্রনাথের সাথে রওনা বিলাতের পথে। লন্ডনে গিয়ে প্রথমে পাবলিক স্কুলে
তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। কিন্তু পড়াশুনায় মন নেই, বেশির ভাগ সময় কাটে
সাহিত্য চর্চা আর নাচে-গানে। দেড় বছর বিলেতে কাটালেন! যে উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন তার
কিছুই হল না। দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশে দেশে ফিরে এলেন। তখন তিনি উনিশ বছরের এক তরুণ
যুবক।
কবির মন তখন নতুন কিছু
সৃষ্টির জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। লিখলেন গীতিনাট্য “বাল্মীকি প্রতিভা”-কবি প্রতিভার
শ্রম সার্থক প্রয়াস যা আজও সমান জনপ্রিয়। তরুণ কবির হাতে ঝর্ণাধারার মত কবিতা রচিত
হতে থাকে। প্রকাশিত হল ভগ্নহৃদয় রুদ্রচণ্ড। কবি প্রতিভার পূর্ণ প্রকাশ না ঘটলেও সেই
সময় এই কাব্য দুটি অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও
ভাবি কাদম্বী দেবী তখন ছিলেন চন্দননগরে। কবি গেলেন তাঁদের কাছে, বাড়ি পাশেই গঙ্গা।
এখানে বসেই রবীন্দ্রনাথ লিখলেন “বৌঠাকুরাণীর হাট” তাঁর প্রথম উপন্যাস, প্রতাপদিত্যের
জীবন অবলম্বনে এর কাহিনী গড়ে উঠেছে। বৌঠাকুরাণীর হাট ধারাবাহিকভাবে ভারতী পত্রিকায়
প্রকাশিত হয় (১৮৮৩)। বীবাহিক জীবনঃ- চন্দননগর
থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এসে বাসা বাঁধলেন সদর স্ট্রীটের বাসা বাড়িতে। এখানে কবির জীবনে
ঘটল এক নতুন উপলব্ধি। এই অপূর্ব অনুভূতির মধ্যে দিয়েই জন্ম হল কবির অন্তস্তি কাব্যসত্তার।
সেই দিনই কবি লিখলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ। ১৮৮৩, ৯ই ডিসেম্বর, রবীন্দ্রনাথের
বিবাহ হল ঠাকুর বাড়িরই এক কর্মচারীর কন্যা। বারাে বছর বয়স। বিয়ের আগে নাম ছিল ভবতারিণী।
নতুন নাম হল মৃণালিনী ছিল ।
সাহিত্য
রচনাঃ- ঠাকুরবাড়ি
শুধু যে বাংলার সংস্কৃতির জগতের ক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিল তাই নয়, আর্থিক দিক থেকেও
অন্যতম ধনী। পূর্ববঙ্গ উত্তরবঙ্গে ছিল বিস্তৃত জমিদারি । সব ভার এসে পড়ল রবীন্দ্রনাথের
উপর। বাংলার গ্রামেগঞ্জে নদীপথে ঘুরতে ঘুরতে রবীন্দ্রনাথ যে বিপুল অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন
তা তাঁর সাহিত্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। বিভিন্ন সময়ে লেখা কবিতাগুলি নিয়ে প্রকাশিত
হল মানসী (১৮৯০)। এতে কবি প্রতিভার শুধু যে পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে তাই নয়, বাংলা কাব্য
জগতেও এ এক নতুন সংযােজন। বন্ধু শ্ৰীশচীন্দ্র প্রকাশ করলেন নতুন একটি পত্রিকা ‘হিতবাদী।'
রবীন্দ্রনাথ হলেন এর সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক। সেই সময় জমিদারির কাজে নিয়মিত যেতে
হল শিলাইদহে। সেখানে ঘুরে বেড়ান গ্রামে গ্রামে। সেখানকার মানুষের ছােট ছােট সুখ-দুঃখের
আলােয় জন্ম দিতে থাকে একের পর এক ছােট গল্প-দেনা-পাওনা, গিন্নি, পােস্টমাস্টার, ব্যবধান
রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা, প্রতিটি গল্প প্রকাশিত হয় হিতবাদীতে। কিন্তু কয়েক মাস
পরেই হিতবাদীর সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল আর ভ্রাতৃপুত্রেরা একটি পত্রিকা বের
করল, 'সাধনা'। রবীন্দ্রনাথের গল্পের জোয়ার বইতে শুরু হল। প্রথম গল্প বার হল খােকা
বাবুর প্রত্যাবর্তন, তারপর সম্পত্তি সমর্পণ কঙ্কাল, জীবিত ও মৃত, স্বর্ণমৃগ, জয় পরাজয়
দালিয়া। প্রতিটি গল্পই বিয়ােগান্ত। নিজের দেশ ও দেশবাসীর প্রতি ছিল তার গভীর শ্রদ্ধা।
ভারতে ইংরেজ শাসনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে লিখেছিলেন বেশ কিছু প্রবন্ধ,
"ইংরেজ ও ভারতবাসী) “ইংরেজের আতঙ্ক, সুবিচারের অধিকার”, “রাজা ও প্রজা"।
পরের বছর প্রকাশিত হল চিত্রা আর চৈতালি। চিত্রায় কবি স্বপ্নলােক থেকে বাস্তব জীবনের
পটভূমিতে নেমে এসেছেন। এতে সংকলিত হয়েছে কবির কিছু অবিস্মরণীয় সৃপ এবার ফিরাও মােরে
পুর্বল নয় বর বধু ছাড়া তাঁর দুটি জনপ্রিয় কবি পুরাতন স্কৃতি, ওই বিঘা জমিতে অবহেলিত
নির্যাতিত মানুষের প্রতি ফুটে উঠেছে গভীর সমবেদনা। কবিতা আর
গানের পাশাপাশি লিখতে
থাকেন একের পর এক কাব্য নাটক। বহুদিন পূর্বে লিখেছিলেন প্রকৃতির পরিশোধ, চিত্রাঙ্গদা,
বিদায়, অভিশাপ, মালিনী। এবার লিখলেন গান্ধারীর আবেদন, সতী, নরকবাস, লক্ষ্মীর পরীক্ষা।
কবিতা আর গানের জগতে থাকতে মন যেন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল। লিখলেন হাস্যরসাত্মক রচনা
চিরকুমার সভা। ১৩০৮ (ইং ১৯০১) নতুন করে বঙ্গদর্শন প্রকাশিত হল। রবীন্দ্রনাথ হলেন তার
সম্পাদক। প্রবন্ধ কবিতার সাথে প্রকাশিত হল নতুন উপন্যাস চোখের বালি।
বিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠাঃ- শিলাইদহে
বুহুদিন ছিলেন সপরিবারে। এলেন শান্তিনিকেতনে। এখানে প্রতিষ্ঠা করলেন আবাসিক বিদ্যালয়।
স্ত্রী মৃণালিনী দেবী অসুস্থ হয়ে পড়লেন, কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। অল্পদিনের মধ্যেই
তাঁর মৃত্যু হল। তখন মৃনালিণী দেবীর বয়স ছিল ত্রিশ, রবীন্দ্রনাথের একচল্লিশ। তাঁদের
তিন কন্যা মাধুরীলতা, রেণুকা, মীরা, দুই পুত্র রবীন্দ্রনাথ আর মনীন্দ্র। মৃণালিনী দেবীর
মৃত্যুর অল্পদিন পরই কন্যা রেণুকা অসুস্থ হয়ে পড়ল। কবির আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও
বাঁচানাে গেল না। তখন রেণুকার বয়স মাত্র তেরাে। কবির ভাবনা বিকশিত হয়ে ওঠে শান্তিনিকেতন
আর শিলাইদহে। তারই সাথে গীতাঞ্জলির গান লেখা। প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের
অনুরােধে কবি লিখতে আরম্ভ করলেন ‘গােরা' উপন্যাস। প্রায় তিন বছর ধরে গােরা প্রকাশিত
হল প্রবাসীতে। রবীন্দ্রনাথের এক শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। হিন্দু সমাজ জীবন, তার দশীয় সংকীর্ণতা,
জাতিভেদের ঊর্ধ্বে রবীন্দ্রনাথ এক সত্যের ইঙ্গিত করেছেন। শান্তিনিকেতনে বসে কবি লিখেছেন
‘ডাকঘর'। বহুদিন দেশের বাইরে যাননি রবীন্দ্রনাথ। পুত্র-পুত্রবধূ প্রতিমাকে নিয়ে গেলেন
বিলেতে। বিলেতে এসে কবির সাথে পরিচয় হল ইংরেজ কবি ইয়েটস-এর সাথে। ইয়েটস্ রবীন্দ্রনাথের
গীতাঞ্জলি অনুবাদ পড়ে মুগ্ধ। তিনি এর ভূমিকা লিখলেন। ইন্ডিয়া সােসাইটি থেকে প্রকাশিত
হল গীতাঞ্জলি। ইংল্যান্ডের শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। কাগজে কাগজে উচ্ছসিত
প্রশংসা। কবি আমেরিকা হয়ে ফিরে এলেন কলকাতায়। সেখানকার পরিবেশ ভাল লাগে না।
পুরষ্কার
লাভঃ- ১৫ই নভেম্বর
১৯১৩ ফিরে এলেন শান্তিনিকেতনে। সন্ধ্যাবেলায় সংবাদ এল কবি সাহিত্যের জন্য নােবেল পুরস্কার
পেয়েছেন। তিনিই প্রথম প্রাচীনবাসী যিনি এই পুরস্কার পেলেন। লিখলেন নতুন কবিতা ‘ছবি।
তারপর একের পর এক সৃষ্টি হতে থাকে বলাকার অবিস্মরণীয় সব কবিতা। সবুজের অভিযান, শখ,
শাজাহান, ঝড়ের খেয়া, বলাকা। নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে সবুজ পত্র'। নতুন কোন পত্রিকা
চালু হলেই তাকে ভরিয়ে তােলবার দায়িত্ব এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপর। সবুজ পত্রে একের
পর এক প্রকাশিত হল ছােট গল্প। এদের মধ্যে বিখ্যাত হৈমন্তী, বােষ্টমী, স্ত্রীর পত্র।
শেষ
জীবনঃ- কবির স্বাস্থ্য
ভেঙে পড়েছে। দেহ আগের মত সচল নয়। তবুও তারই মধ্যে লিখলেন তাঁর বিখ্যাত গল্প ল্যাবরেটরি,
বদনাম। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বলে যান অন্যে লিখে নেয়। এই সময়ে লেখা কবিতাগুলি সংকলিত
হয়ে প্রকাশিত হল ‘রােগশয্যায়'। কবি শান্তিনিকেতনে ছিলেন। চিকিৎসার জন্য কলকাতা নিয়ে
আসা হল। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কবির অপারেশন করা হল। তার কিছুক্ষণ আগে লিখেছেন জীবনের
শেষ কবিতা।
তােমার সৃষ্টির পথ রেখেছে আকীর্ণ করে
বিচিত্র ছলনা জালে হে ছলনাময়ী।
শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে আপন
ভাণ্ডারে
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তােমার হাতে শান্তি অক্ষয়
অধিকার
অপরেশনের পর কবি জ্ঞান
হারালেন। সে জ্ঞান আর ফিরল না। রাখী পূর্ণিমার দিন দুপুর বেলায় ১৩৪৮ সালের ২২শে শ্রাবণ
(ইং ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট) একটি মহাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটল।