সপ্তম শ্রেণি চতুর্থ অধ্যায়
দিল্লি সুলতানের তর্ক আফগান শাসন
5 নম্বরের প্রশ্ন উত্তর
সপ্তম শ্রেণি চতুর্থ অধ্যায় দিল্লি সুলতানের তর্ক আফগান শাসন 5 নম্বরের প্রশ্ন উত্তর
1. আদি মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষে মুসলমান আক্রমণ যা জানাো লেখাো।
উ:-সম্রাট হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর ভারতীয় রাজনীতিতে গভীর শূন্যতা লক্ষ
করা যায়। ভারতের ঐক্যের ধারণা বনষ্ট হয়। এই সুযাোগে ভারতবর্যে বিদেশি মুসলমান শাসকদের
আক্রমণ ঘটে।ভারতবর্যে মুসলমানদের আক্রমণ
i. আরবীয় আক্রমণ: ভারতবর্যে সর্বপ্রথম মুসলমানদের অনুপ্রবেশ ঘটে ৭১২
খ্রিস্টাব্দে। ইরাকের শাসনকর্তা অল-হজ্জাজের সেনাপতি মহম্মদ কাশিম সিন্ধুরাজ দাহিরকে
পরাজিত করে সিধুদেশে আরবদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন।
ii. মাহমুদের নেতৃত্বে তুর্কি আক্রমণ: আরব মুসলমানদের প্রায় ৩০০ বছর
পর গজনির শাসনকর্তা সুলতান মাহমুদ ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন। জানা যায় যে, তিনি ১০০০ খ্রিস্টাব্দ
থেকে ১০২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মাোট সতেরাো বার ভারতবর্ষ আক্রমণ ও লুণ্ঠন করেন। কিন্তু
তিনি ভারতবর্যে স্থায়ীভাবে সাম্রাজ্যবিস্তার করতে আসেননি। তাঁর ভারত আক্রমণের লক্ষ্য
ছিল এদেশের ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে গিয়ে নিজের দেশের উন্নতির কাজে ব্যবহার করা।
iii. মহম্মদ ঘুরি: সুলতান মাহমুদের ভারতবর্ষ আক্রমণের পর গজনির সুলতান
মহম্মদ ঘুরি ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন। ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে তিনি দিল্লি ও আজমিরের শাসক তৃতীয়
পৃথ্বীরাজ চৌহানকে দ্বিতীয় তরাইনের যুদ্ধে পরাজিত করেন। তিনি ভারতবর্ষে তাঁর অধিকৃত
অঞ্চলের শাসনভার কুতুবউদ্দিন নামক এক দাসের হাতে অর্পণ করে গজনি প্রত্যাবর্তন করেন।
iv. উপসংহার: এরপর ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে কুতুবউদ্দিন আইবক গজনির অধীনতা
ছিন্ন করে ভারতবর্ষে দিল্লিকেন্দ্রিক সুলতানি শাসনের সূচনা করেন।
2. কুতুবউদ্দিন আইবকের কৃতিত্ব আলাোচনা
উ:-মহম্মদ ঘুরির মৃত্যুর পর ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে কুতুবউদ্দিন আইবক ‘সুলতান’ হয়ে
দিল্লির সিংহাসনে বসেন। মহম্মদ ঘুরির মৃত্যুর পর তাঁর জয় করা অঞ্চলগুলি তাঁর চার অনুচরদের
মধ্যে বণ্টিত হয়। তাজউদ্দিন ইয়ালদুজ পেলেন গজনি, নাসিরউদ্দিন বাচা পেলেন মুলতান।
বখতিয়ার খলজি পেলেন বাংলাদেশ এবং আইবক পেলেন লাহাোর ও দিল্লি। সিংহাসনে পর তিনি কতকগুলি
সমস্যার সম্মুখীন হন। হল
i. সুলতান হিসেবে অস্বীকার: গজনির শাসনকর্তা তাজউদ্দিন ইয়ালদুজ এবং
মুলতানের শাসনকর্তা নাসিরউদ্দিন কুবাচা তাঁকে স্বাধীন সুলতান হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার
করেন।
ii. বখতিয়ার খলজির দাবি: বাংলার শাসনকর্তা বখতিয়ার খলজি নিজেকে ঘুরির
উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘাষণা করলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করে।
iii. রাজপুতদের স্বাধীনতা: ঘুরির মৃত্যুসংবাদে পরাজিত রাজপুত রাজন্যবর্গের
অনেকেই স্বাধীনতা ঘাোষণা করেন এবং তারা অনেকে পুনরায় তাঁদের নিজস্ব এলাকায় শাসনের
প্রধান হয়ে ওঠেন।
iv. সিংহাসনের ওপর অধিকার: মহম্মদ ঘুরি নির্দিষ্ট কোনাো উত্তরাধিকারী
রেখে না যাওয়ায় সিংহাসনের ওপর কুতুবউদ্দিনের কোনাো বৈধ অধিকার ছিল না। উল্লেখ্য যে,
সিংহাসন আরাোহণকালে তাঁর দাসত্ব মুক্তি হয়নি
v. কিন্তু মহম্মদ ঘুরির উত্তরাধিকারী গিয়াসউদ্দিন ঘুর তাঁকে ‘দাসত্ব
থেকে মুক্তি দিয়ে ‘সুলতান’ বলে ঘাোষণা করেন। এর ফলে তিনি সার্বভৌমত্ব অর্জন করেন।
vi. গজনির অধিপতি হিসেবে তাজউদ্দিন কুতুবউদ্দিনের বশ্যতা স্বীকার করেন
এবং পাঞ্জাব জয়ে অগ্রসর হন।
vii. বখতিয়ার খলজির মৃত্যু হলে ইলদুজ কুতুবউদ্দিন তাঁর অনুগত আলিমর্দানকে
বাংলার সিংহাসনে অভিষিক্ত করে সেখানে আধিপত্য বিস্তার করেন।
কৃতিত্ব: ১২০৬ থেকে ১২১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে ভারতে
তিনি একটি নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন দানশীল ও উদার
চরিত্রের মানুষ। ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ তাঁকে ভারতে মুসলিম অভিযানের মহান অগ্রদূত” বলেছেন।
vii. মন্ত কুতুবউদ্দিন আইবক দিল্লিতে যে-সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন
তা পরবর্তী উত্তরাধিকারীদের অযাোগ্যতার ফলে শেষপর্যন্ত সুলতানি শাসনের পতন ঘটে। কায়ুর্মাস—শেষ
সুলতান (১২৯০ খ্রিস্টাব্দ)
viii. চেঙ্গিস খানের আক্রমণ: মাোঙ্গল নেতা চেঙ্গিজ খান দিল্লির আক্রমণের
উদ্দেশ্যে ভারতের দিকে অগ্রসর হন।
ix. সমস্যার সমাধান: ইলতুৎমিশ দিল্লি সুলতানিতে নিজের অধিকার বজায়
রাখতে নাসিরউদ্দিন, তাজউদ্দিন, আলিমর্দান প্রমুখদের কঠোর হাতে দমন করেন। সবশেষে তিনি
রাজপুত রাজাদের বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করে রাজপুতনার বিভিন্ন অঞ্চল দিল্লি সুলতানির
অন্তর্ভুক্ত করেন।
x. মাোঙ্গল আক্রমণ রাোধ: এশিয়ার কুখ্যাত মাোঙ্গল নেতা চেঙ্গিজ খান
খাওয়ারিজম রাজ্যের অধিপতি জালালউদ্দিন মাঙ্গবারানিকে আক্রমণ করলে মাঙ্গবারানি ইলতুৎমিশের
কাছে আশ্রয় চান। কিন্তু ইলতুৎমিশ দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে সেই আবেদন ফিরিয়ে
দিলে চেঙ্গিজ খান মাঙ্গাবারানির পিছু ধাওয়া করে শেষ পর্যন্ত ফিরে যান। এইভাবে তিনি
দিল্লির সুলতানিকে সুকৌশলে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন।
xi. খলিফার অনুমাোদন: ইলতুৎমিশ খলিফা আবু জাফর আল মুনতাসিবের কাছে নানান
উপহার পাঠিয়ে তাঁর দিল্লি সুন অনুমাোদন প্রার্থনা করেন। খলিফা ইলতুৎমিসকে। দুরবাশ
ও খিলাত পাঠিয়ে তাঁকে ‘সুলতান-ই-আজম’ উপাধিতে
ভূষিত
xii. কৃতিত্ব: দিল্লি সুলতানিতে সুশাসন গড়ে তুলতে ইলতুৎমিশ চল্লিশজন
বান্দা বা অনুগামী নিয়ে গড়ে তাোলেন চল্লিশ চক্র বা ‘বন্দেগান-ই-চিহলগানি। এরাই ছিল
সুলতানি শাসনব্যবস্থার স্তম্ভ। এ ছাড়া তিনি ইকতা বা জায়গিরপ্রথা, রুপাোর মুদ্রা তঙ্কা’, বহু
অট্টালিকা, মসজিদ, এবং মিনার তৈরি করেন। এই জন্য 3. 3. ঐতিহাসিকরা
তাঁকে মামেলুক বা দাস বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক বলে অভিহিত করেন।
উ:- ইলতুৎমিশ ছিলেন দাস বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান। তাঁরই হাত ধরে ভারতবর্ষে
দাস তথা সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রকৃত ভিসি পলিকিল ।
4. ইলতুৎমিশকে দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় কেন
? অথবা, সিংহাসনে বসার সময় তাঁর আমলে কী কী সমস্যা ছিল ? তিনি সমস্যার সমাধান করেন
কীভাবে ?
উ:-ইলতুৎমিশ ছিলেন দাস বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান। তাঁরই হাত ধরে ভারতবর্ষে
দাস তথা সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রকৃত ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। & ইলতুৎমিশ কেন প্রকৃত
প্রতিষ্ঠাতা
i. সুলতানের সমস্যা: কুতুবউদ্দিন আইবকের পর ১২১১ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির
মসনদে বসেন তাঁরই জামাতা ইলতুৎমিশ। কিন্তু সিংহাসনে বসে তাঁকে কতকগুলি সমস্যার সম্মুখীন
হতে হয়। এগুলি ছিল—প্রথমত, সিন্ধুপ্রদেশের শাসনকর্তা নাসিরউদ্দিন কুবাচার বিদ্রোহ, দ্বিতীয়ত,
বাংলার শাসক আলিমদানের বিদ্রোহ, তৃতীয়ত, রাজপুতদের স্বাধীনতা লাভ, চতুর্থত, দিল্লির
আমির-ওমরাহদের বিদ্রোহ এবং পঞ্চমত, মাোঙ্গল নেতা চেঙ্গিজ খান-এর ভারত আক্রমণের প্রবল
সম্ভাবনা।
ii. বিদ্রোহ দমন: প্রথমেই তিনি
একে একে উপরাোক্ত বিদ্রোহগুলি কঠোর হস্তে দমন করেন।
iii. তিনি তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আরামশাহকে পরাজিত ও নিহত করেন।
iv. এরপর তাজউদ্দিন ইলদুজকে
দমন করেন।
v. ১২২৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলার
শাসনকর্তা আলিমর্দান ইলতুৎমিশের বশ্যতা স্বীকার করে নেন।
vi. রাজ্যজয়: ১২২৬-১২৩৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইলতুৎমিশ রণথম্ভোর, গাোয়ালিয়র,
মালব প্রভৃতি রাজ্যে সুলতানি আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন।
vii. মাোঙ্গল আক্রমণ প্রতিরাোধ: ১২২০ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গিজ খান খাওয়ারিজম
রাজ্যের শাসনকর্তা মাঙ্গবারনির পিছু নেন। মাঙ্গবারনি পাঞ্জাবে উপস্থিত হয়ে ইলতুৎমিশের
আশ্রয়প্রার্থী হন। কিন্তু দূরদর্শী সুলতান তাঁর অনুমতি মঞ্জুর করেননি। ফলত, চেঙ্গিজ
খান ভারত আক্রমণে বিরত হন।
viii. উপসংহার: এইভাবে ইলতুৎমিশ বিভিন্ন বিদ্রোহ দমন ও রাজ্যবিস্তার
করেন এবং মাোঙ্গল আক্রমণের হাত থেকে সুলতানি সাম্রাজ্যকে রক্ষা করেন। এজন্য ঐতিহাসিক
ঈশ্বরীপ্রসাদ তাঁকে ‘দাসবংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলেছেন।
5. টীকা লেখাো : ইকতা প্রথা।
উ:- সুলতানি যুগের অর্থনীতি ও সামরিক শক্তির অন্যতম উৎস ছিল ইকতা। এই
ব্যবস্থার প্রবর্তক ছিলেন ইলতুৎমিশ।
i. ইকতা কী শাসনব্যবস্থার সুবিধার জন্য ইলতুৎমিশ সুলতানি সাম্রাজ্যকে
কয়েকটি অংশ বা সামরিক এলাকায় বিভক্ত করেন। এই সামরিক এলাকার প্রধান নিয়ামককে বলা
হত ইকতাদার বা মুফতি বা ওয়ালি। আসলে এটি ছিল একপ্রকার জায়গিরদারিপ্রথা।
ii. ইকতাদারদের দায়িত্ব: ইকতাদারগণ নির্দিষ্ট পরিমাণ জমির বিনিময়ে
কতকগুলি দায়-দায়িত্ব পালনে বাধ্য থাকতেন,
iii. এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা
বজায় রাখা।
iv. রাজস্ব আদায় করা এবং তা
সরকারি তহবিলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমা দেওয়া।
v. যুদ্ধের সময় সুলতানকে সৈন্য
দিয়ে সাহায্য করা।
vi. যে সমস্ত সৈন্যবাহিনীর ভরণপাোষণের দায়িত্ব ইকতাদারদের ছিল তাদের
বেতন তাঁরাই দিতেন।
vii. রদবদল: আলাউদ্দিন খলজি ইকতা ব্যবস্থায় কিছু রদবদল করেন। সাম্রাজ্যের
দূরবর্তী এলাকাতেই তিনি কেবল ইকতাদারদের নিয়াোগ করতেন। বাকি জমি খাস জমিতে পরিণত করেন।
এদের সরকারি কর্মচারীদের মতাো এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বদলি করা হত, যাতে তাঁদের
মধ্যে দুর্নীতি প্রবেশ -করে।
6. মহিলা সুলতান রাজিয়ার পরিচয় দাও।
উ:-ইলতুৎমিশের সার্থক উত্তরাধিকারী ছিলেন সুলতান রাজিয়া (১২৩৬ খ্রিস্টাব্দ-১২৪০ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ছিলেন ইলতুৎমিশের সন্তানদের মধ্যে যাোগ্যতম। তাঁর শাসনকাল দিল্লি সুলতানির ইতিহাসে দু-ভাবে উল্লেখযাোগ্য হয়ে আছে এই প্রথম ও শেষবার একজন নারী সুলতান পদে বসেছিলেন। এবং ‘বন্দেগান-ই-চিহলগানি’ বা চল্লিশ চক্রের সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক জটিল আকার ধারণ করলে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল।