বিভিন্ন ধরনের স্মৃতিকথার বিবরণ দাও। ইতিহাস রচনায় স্মৃতিকথার গুরুত্ব ত্রুতি ও লেখাে।

0

 বিভিন্ন  ধরনের স্মৃতিকথার বিবরণ দাও। ইতিহাস রচনায় স্মৃতিকথার গুরুত্ব ত্রুতি ও লেখাে।

বিভিন্ন  ধরনের স্মৃতিকথার বিবরণ দাও। ইতিহাস রচনায় স্মৃতিকথার গুরুত্ব ত্রুতি ও লেখাে।





ভূমিকা :জনশ্রুতির একটি অন্যতম উপাদান হল স্মৃতিকথা। উদাহরণ হল কোনাে ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত বা ঐতিহাসিক কোনাে ঘটনার সাক্ষী কোনাে ব্যক্তি তার অতীত স্মৃতি থেকে অতীতের ঘটনাটির যে বিবরণ দেন, তাকে স্মৃতিকথা বলে।


স্মৃতিকথার বিবরণ : স্মৃতিকথার উল্লেখযােগ্য কয়েকটি উদাহরন হয়


(i) জ্যোতি বসুর স্মৃতিকথা : পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থটি হল প্রাক্তন যতদূর মনে পড়ে। এই গ্রন্থটি থেকে সেই সময়কার ইংরেজ শাসন, ভারতবাসীর ওপর ইংরেজদের অত্যাচার, ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর স্বাধীনতার সংগ্রাম ও স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক ঘটনা সম্পর্কে ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায়।


(ii) আশালতা সেনের স্মৃতিকথা : বিপ্লবী আশালতা সেনের স্মৃতিকথামূলক বিখ্যাত গ্রন্থটি হল ‘আমি সূর্য সেনের শিষ্যা। এই গ্রন্থটির থেকে তার ব্রিটিশ বিরােধী মানসিকতা সৃষ্টির কাহিনি, মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবী দলে তাঁর যােগদান, সূর্য সেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ, মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়া, ইংরেজদের সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রাম, জেলখানায় তাঁর বন্দি জীবনের পরিচয় আছে।


(iii) নারায়ণ সান্যালের স্মৃতিকথা : বিখ্যাত সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যালের লেখা ‘আমি নেতাজিকে দেখেছি’ গ্রন্থটি একটি মূল্যবান স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ। এই গ্রন্থলেখক একজন। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে নেতাজির জীবনের বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনা প্রকাশ করেছেন। এই গ্রন্থটিতে সুভাষচন্দ্র বসুর সম্পর্কে ও সমকালীন ঘটনা সম্পর্কে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়।


(iv) মণিকুন্তলা সেনের স্মৃতিকথা : 1946 খ্রিস্টাব্দের 16 আগস্ট কলকাতা দাঙ্গার বিবরণ পাওয়া যায় মণিকুন্তলা সেনের স্মৃতিকথা ‘সেদিনের কথা’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থটি কলকাতা দাঙ্গার একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান। এই গ্রন্থে তিনি লিখেছেন—মুসলিম লিগ একটা মিছিলে যােগ দিতে মুসলিম জনতাকে আহ্বান জানালে, এই মিছিল থেকে একটা কিছু ঘটবে এটা সবাই অনুমান করেছিল। মিছিল যতই এগােতে থাকে সরাসরি লুটপাট ততই বাড়তে থাকে।


(v) সুফিয়া কামালের স্মৃতিকথা :বর্তমান বাংলাদেশের বিখ্যাত কবি সুফিয়া কামাল-এর ‘একাত্তরের ডায়েরী একটি বিখ্যাত স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ। এই গ্রন্থে 1971 খ্রিস্টাব্দের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব বাংলার মানুষের ওপর যে নির্মম অত্যাচার চালিয়েছিল তার খণ্ড খণ্ড চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এই গ্রন্থটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল।


(vi) কংগ্রেসের প্রয়াত শীর্ষ নেতা অমূল্য ঘােষের কষ্ট কল্পিত’গ্রন্থে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বিবরণ পাওয়া যায়ঃ


সদ্য প্রয়াত ঐতিহাসিক তপনমােহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘বাঙালি নামা’ ভারতবর্ষে ইতিহাসচর্চার মনােজ্ঞ বিবরণ।



 ইতিহাস রচনায় স্মৃতিকাৰ গুৰুত্ব :ইতিহাস রচনার স্মৃতিকথার বিবরণগুলি উল্লেখযােগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে।


(i)স্মৃতিকথাগুলি থেকে অতীতকালের অনেক অজানা তথ্য জানা যায়। যেমন আশালতা সেনের স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ থেকে আমরা জেলের ভেতরে ইংরেজ পুলিশ মহিলাদের ওপর কীরকম অত্যাচার করত তা জানা যায়।


(ii) গৃহযুদ্ধ, স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় যখন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকে না অথবা সংবাদমাধ্যমগুলি এতটা উন্নত হয়নি, তখন স্মৃতিকথাগুলি থেকে ওই সময়ের অবস্থা জানা যায়। যেমন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পূর্ববাংলার সব সংবাদমাধ্যমকে সমগ্র বিশ্ব থেকে আড়াল করে রেখেছিল। অতএব সত্য ঘটনা জানার জন্য ওই সময়ের স্মৃতিকথাগুলি বিশেষ উল্লেখযােগ্য।


(iii) স্মৃতিকথাগুলিতে প্রত্যক্ষদর্শীরা ঘটনার বিবরণ দেন। তাই স্মৃতিকথাগুলির ঐতিহাসিক সত্যতা অনেক বেশি।


(iv) স্মৃতিকথাগুলি প্রায় অধিকাংশই বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের লেখা। ফলে স্মৃতিকথাগুলিতে অবান্তর, অবাস্তব, অতিরঞ্জিত পক্ষপাতদুষ্ট ও কাল্পনিক ঘটনা খুব কম থাকে। স্মৃতিকথাগুলি যতটা সম্ভব নিরপেক্ষভাবে বাস্তব ঘটনার বিবরণ তুলে ধরে। স্ট স্মৃতিকথার ত্রুটি : স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থগুলির বেশ কিছু ব্ৰটিও আছে, যেমন—


(i) মতাদর্শের সংকীর্ণতা : কোনাে কোনাে স্মৃতিকথায় লেখক তার নিজস্ব মতাদর্শগত সংকীর্ণতার জন্য প্রকৃত ঘটনাকে অনেক সময় অতিরঞ্জিত করেন বা বিকৃত করেন। অনেক সময় মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন।


(ii) অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিতদের সমস্যা: অনেক সময় অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত ব্যক্তিরা তাদের স্মৃতিকথায় অতীত ঘটনাটির প্রকৃত তথ্য তুলে ধরতে পারেন না। এর ফলে ঘটনার তাৎপর্য বােঝা যায় না।


(iii) একই বিষয়ের পার্থক্য : একই ঘটনা পরবর্তীকালে বিভিন্ন ব্যক্তি তাদের স্মৃতিকে বিভিন্নভাবে প্রকাশ করেন, ফলে প্রকৃত ঘটনাটি জানা যায় না।


(iv) স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থগুলিতে অনেক সময়ে লেখকের স্মৃতিবিভ্রমও ঘটতে পারে।


মূল্যায়ন : ত্রুটি সত্ত্বেও স্মৃতিকথাগুলি ইতিহাস রচনার উল্লেখযােগ্য উপাদান, কারণ বিখ্যাত ব্যক্তিরা বাস্তব ঘটনাটি নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরেন। সেই সময় সত্য ঘটনাটি বলার ক্ষেত্রে বাধা থাকলেও পরবর্তীকালে লেখার মধ্যে তুলে ধরেন। ফলে প্রকৃত ইতিহাস জানা যায়।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top