কিংবদন্তির সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যগুলি লেখাে। কয়েকটি কিংবদন্তির উদাহরণ দাও
কিংবদন্তির সংজ্ঞা : পাশ্চাত্য জগতের প্রচলিত আঞ্চলিক ঐতিহ্য, লেজেন্ড ও জনপ্রিয় অ্যান্টিকুইটিস (antiquities) নামের আঙ্গিককে বাংলায় কিংবদন্তি বলে। কিংবদন্তিতে অতীতের কোনাে চরিত্রকে অতিমানবরূপে তুলে ধরা হয়। এর ফলে কিংবদন্তিতে বাস্তব অপেক্ষা কল্পনার আধিক্য বেশি থাকে। লােকসমাজ বিশ্বাস করে কিংবদন্তির চরিত্রগুলি একসময় জীবিত ছিল। কিংবদন্তিগুলিতে কিছু কিছু ঐতিহাসিক তথ্য ও সূত্র আছে বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। প্রাগৈতিহাসিক যুগে পৌরাণিক কাহিনির পর কিংবদন্তিগুলির উদ্ভব হয়।
কিংবদন্তির বৈশিষ্ট্য :প্রাচীন কিংবদন্তি বা লেজেন্ডগুলির বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
i) বিস্ময় ও কল্পনা : কিংবদন্তির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বিস্ময় ও কল্পনার আধিক্য। প্রাথমিক অবস্থাতে কিংবদন্তিতে ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্র নিহিত থাকে। কিন্তু ঘটনার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে কল্পনা ও বিস্ময়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। প্রকৃত ঐতিহাসিক তথ্যগুলি লােপ পায়। এজন্য কিংবদন্তিকে ইতিহাসের অপক্ক ফসল বলা হয়।
ii) অতিরঞ্জন : কিংবদন্তির অপর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল অতিরঞ্জন করার প্রবণতা। কিংবদন্তিতে অতীতের কোনাে বিখ্যাত ব্যক্তির বাস্তব জীবনের সঙ্গে বিভিন্ন অতিমানবীয় ও অতিরঞ্জিত ঘটনা যােগ করে কিংবদন্তির চরিত্রগুলি নির্মাণ করা হয়। এজন্য কিংবদন্তিগুলিতে ভিত্তিহীন বিভিন্ন ঘটনার অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়।
iii) কেন্দ্রীয় চরিত্র : প্রতিটি কিংবদন্তিতে একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র থাকে এবং এই চরিত্রটি এক সময় জীবিত ছিল। রামচন্দ্র, শ্রীকৃয়, হারকিউলিস এক সময় বাস্তবে ছিল তা ঐতিহাসিকগণ স্বীকার করেন, তবে তারা সাধারণ মানুষের থেকে বেশি ক্ষমতাবান, সাহসী ও মানবদরদী ছিলেন।
iv) বিষয়বস্তুর ভিন্নতা : কিংবদন্তির কাহিনির বিষয়বস্তু নানা রকমের হতে পারে, যেমন— আধ্যাত্মিক ঘটনা, পরিদের কাহিনি, ভূতপ্রেতের ঘটনা, প্রেমকাহিনি, সন্ন্যাসী, ফকির ও দরবেশের কাহিনি, এমনকি কোনাে ঐতিহাসিক কাহিনি বা চরিত্রও কিংবদন্তির বিষয়বস্তু হতে পারে।
কিংবদন্তির উদাহরণ বিভিন্ন দেশে অসংখ্য কিংবদন্তির কাহিনী প্রচলিত আছে। এই কাহিনিগুলি দেশকালের গণ্ডি অতিক্রম করে অজিও জনগণের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। উল্লেখযােগ্য কয়েকটি কিংবদন্তি চরিত্রের উদাহরণ হল—
(i) হারকিউলিস : প্রাচীন গ্রিসের কিংবদন্তি চরিত্রগুলির অন্যতম হলেন হারকিউলিস। তিনি ছিলেন উত্তর আফ্রিকার সুদক্ষ যােদ্ধা এবং রণনিপুণ সেনাপতি। গ্রিক কিংবদন্তি অনুসারে হারকিউলিস হলেন দেবতাদের রাজা জিউসের পুত্র। স্বর্গের দেবী হেরা ঘুমন্ত শিশু হারকিউলিসকে হত্যা করার জন্য দুটি সাপকে পাঠান। কিন্তু হারকিউলিস ঘুম থেকে জেগে উঠে সাপ দুটিকে মেরে ফেলেন। যৌবনে হারকিউলিসের বহু বীরত্বের কাহিনি আছে। তার মৃত্যুর পর তার নামের সঙ্গে বহু কাল্পনিক ঘটনা যুক্ত হয়। হারকিউলিসকে নিয়ে বীর পূজা শুরু হয়।
(ii) প্রমিথিউস :প্রাচীন গ্রিসের আর এক বিখ্যাত কিংবদন্তি চরিত্র হল প্রমিথিউস। গ্রিক কিংবদন্তি অনুসারে প্রমিথিউস মানুষকে প্রথম সােজা হয়ে হাঁটতে শেখান। অন্যান্য জীব অপেক্ষা মানুষকে শ্রেষ্ঠ ও মহত্তর বলে ঘােষণা করেন। তিনি স্বর্গে গিয়ে সূর্যের কাছ থেকে মর্ত্যলােকে আগুন নিয়ে এসে মানুষকে উপহার দেন। মানুষকে আগুন উপহার দেওয়ার ফলে দেবতাদের রাজা জিউস তার প্রতি ক্ষুদ্ধ হয়ে পাহাড়ের সঙ্গে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখে নির্মম অত্যাচার চালান। প্রতিদিন একটি বাজপাখি এসে তার কলিজাটি ছিড়ে খেত এবং নতুন একটি কলিজার জন্ম হত।
(iii) শ্রীকৃষ্ণু : প্রাচীন ভারতের অন্যতম কিংবদন্তি চরিত্র হল শ্রীকৃয়। মহাকবি ব্যাসদেবের মহাভারত মহাকাব্যে শ্রীকৃয় চরিত্রটি উল্লেখিত আছে। শ্রীকৃষ্ণ কংসের কারাগারে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে অত্যাচারী কংসকে বধ করে মথুরাবাসীকে রক্ষা করেন। তিনি নরকাসুরকে বধ করে গােপিনীদের উদ্ধার করেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের সারথিরূপে অর্জুনকে গীতার শ্লোক শােনান ইত্যাদি।
(iv) রামচন্দ্র : প্রাচীন ভারতের অপর একটি জনপ্রিয় কিংবদন্তি চরিত্র হল রামচন্দ্র। মহাকবি বাল্মীকির রামায়ণ মহাকাব্যে রামচন্দ্র চরিত্রটি উল্লেখিত আছে। রামচন্দ্র অযােধ্যার রাজা দশরথের পুত্র। পিতৃসত্য রক্ষার জন্য তিনি পত্নী সীতা ও ভ্রাতা লক্ষণকে নিয়ে চোদ্দো বছরের জন্য বনবাসে যাত্রা করেন। খর, দূষণ, মারিচ প্রভৃতি রাক্ষসদের বধ করেন ও তারপর রাক্ষসদের রাজা রাবণকে বধ করে সীতাকে উদ্ধার ও অযােধ্যার সিংহাসন লাভ করেন।
(v) রবিনহুড : ইংল্যান্ডের অন্যতম জনপ্রিয় কিংবদন্তি চরিত্র হল রবিনহুড। তিনি ব্রিটেনের শেরউড জঙ্গলের একজন বিখ্যাত ডাকাত—যিনি ধনীদের সঞ্চিত অর্থ লুঠ করে গরিব ও দুঃখীদের অকাতরে বিতরণ করেন। এই মহানুভবতার জন্য দেশকালের সীমা ছাড়িয়ে তিনি পৃথিবীর সমস্ত দেশে
তিনি জনপ্রিয়।
(vi) অন্যান্য চরিত্র : এই চরিত্রগুলি ছাড়াও ভারতে কতকগুলি উল্লেখযােগ্য ও জনপ্রিয় চরিত্র আছে। এগুলি হল— উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্য, নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের হাস্যরসিক গােপাল ভাঁড়, বীরসা মুন্ডা, সিধু, কানু, রঘু ডাকাত প্রমুখ। ভারতীয় সমাজ ও ধর্মে এই কিংবদন্তি চরিত্রগুলিকে দেবতা বা যুগনায়করূপে পূজা করা হয়।