সন্ধির সংজ্ঞা এবং শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা (বাংলা ব্যাকরণ)
১.
সন্ধির স্বরূপ: ‘দেব-আলয়’,
‘উৎ-জ্বল’, ‘মনঃ-ভাব’ তাড়াতাড়ি বার কয়েক উচ্চারণ করে দেখবে ওগুলি যথাক্রমে দেবালয়,
উজ্জ্বল, মনােভাব এরকম উচ্চারিত হচ্ছে। একে সন্ধি বলে। সন্ধি’ শব্দটির অর্থ মিলন। ব্যাকরণে
সন্ধির অর্থ দ্রুত উচ্চারণের সময় পাশাপাশি থাকা দুটি ধ্বনির পরিবর্তন। সন্ধির ফলে
দুটি ধ্বনির মিলন, পরিবর্তন বা লােপ হতে পারে। “এইরূপ মিলন বা লােপ বা পরিবর্তনকে সন্ধি
বলে।' – (ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়)।
অতএব বলা যায়, দ্রুত
উচ্চারণের সময় সন্নিহিত দুটি ধ্বনির মিলনে যে ধ্বনিগত পরিবর্তন হয় তাকে সন্ধি বলে।
সন্ধি করে বললে শব্দটি
আকারে ছােট হয়, দ্রুত উচ্চারণ করা যায় এবং শুনতেও ভাল লাগে। সন্ধির ফলে ধ্বনির বিকার,
পরিবর্তন, লােপ বা নতুন ধ্বনির আগম হয় ফলে শব্দের আকৃতিগত পরিবর্তন ঘটে, কিন্তু অর্থের
কোন পরিবর্তন হয় না।
[•
মনে রাখবে: সন্ধির
ভিত্তি উচ্চারণ, দ্রুত উচ্চারণের সময় পাশাপাশি থাকা দুটি ধ্বনি মিলে যায়। মনে রাখবে,
সন্ধির অর্থ বর্ণে বর্ণে মিলন নয় ধ্বনিতে ধ্বনিতে মিলন। বর্ণ যেহেতু ধ্বনির লিখিত
রূপ বা চিহ্ন, তাই সন্ধির নিয়মগুলির আলােচনায় ‘বর্ণ’ শব্দটি ধ্বনি অর্থেই ব্যবহার
করা হয়।]
২.
সন্ধির প্রকার ভেদ:
সন্ধি তিন প্রকার স্বরসন্ধি, ব্যঞ্জনসন্ধি ও বিসর্গসন্ধি।
স্বরসন্ধি: পাশাপাশি থাকা দুটি স্বরধ্বনির মিলনে
যে সন্ধি হয়, তাকে স্বরসন্ধি বলে। যথা দেব + আলয় (অ + আ = দেবালয় (স্বর + স্বর
= স্বরসন্ধি)।
ব্যঞ্জনসন্ধি: ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে স্বরধ্বনি বা
ব্যঞ্জনধ্বনির মিলনে যে সন্ধি হয়, তাকে ব্যঞ্জনসন্ধি বলে। যথা
(ক) পরি + ছেদ (ই +
ছ) = পরিচ্ছেদ (স্বর + ব্যঞ্জন = ব্যঞ্জনসন্ধি)
(খ) ণিচ্ + অন্ত (চ্
+ অ) ণিজন্ত (ব্যঞ্জন + স্বর = ব্যঞ্জনসন্ধি)
(গ) বাক্ + ময় (ক
+ ম = বাত্ময় (ব্যঞ্জন + ব্যঞ্জন = ব্যঞ্জনসন্ধি)
বিসর্গসন্ধি: পূর্বপদের শেষে বিসর্গ এবং পরপদের
প্রথমে স্বর বা ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে, বিসর্গের সঙ্গে স্বর বা ব্যঞ্জনধ্বনির যে মিলন,
তাকে বিসর্গসন্ধি বলে। যথা, -
(ক) দুঃ + অবস্থা (ঃ
+ অ) = দুরবস্থা (বিসর্গ + স্বর = বিসর্গসন্ধি)
(খ) নিঃ + চয় (ঃ +
চ) = নিশ্চয় (বিসর্গ + ব্যঞ্জন = বিসর্গসন্ধি)
এছাড়া রয়েছে নিপাতনে
সিদ্ধ স্বরসন্ধি, ব্যঞ্জনসন্ধি ও বিসর্গসন্ধি। সন্ধির প্রচলিত নিয়ম না মেনে যেখানে
সন্ধি হয়, তাকে বলা হয় নিপাতনে সিদ্ধ সন্ধি। যথা (ক) মার্ত + অণ্ড (অ + অ) মার্তণ্ড
(নিপাতনে সিদ্ধ স্বরসন্ধি) (খ) গাে + পদ (ও + ) = গােষ্পদ (নিপাতনে সিদ্ধ ব্যঞ্জনসন্ধি)
(গ) মনঃ + ঈষা (ঃ + ঈ) = মনীষা (নিপাতনে সিদ্ধ বিসর্গসন্ধি)
৩. বাংলা তৎসম শব্দে
(বাংলা ভাষায় গৃহীত সংস্কৃত শব্দ) সংস্কৃত ব্যাকরণের সন্ধির নিয়মগুলি সাধারণত অনুসরণ করা হয়ে থাকে।
সংস্কৃত ভাষায় একপদে
অর্থাৎ প্রত্যয় নিষ্পন্ন পদে (যথা Vগৈ + গায়ক), ধাতু ও উপসর্গের মধ্যে (যথা পরি
+ ঈক্ষা = পরীক্ষা) এবং সমাসবদ্ধপদে (নীল + আকাশ = নীলাকাশ) সন্ধি করাই নিয়ম। বাংলা
ভাষায় সন্ধির ক্ষেত্রে প্রথম দুটি নিয়ম মানা হলেও সমাসবদ্ধ পদে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই
সন্ধি করা হয় না।
খাঁটি বাংলা সন্ধি
বাংলা ভাষার নিজস্ব
উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য আছে, এবং সেই অনুযায়ী ধ্বনি বা বর্ণের সংযুক্তি ঘটে। এই ধ্বনি সংযুক্তি
বা সন্ধি ঠিক সংস্কৃত সন্ধির নিয়ম মেনে হয় না। সমীকরণ, স্বরসঙ্গতি, বর্ণলােপ ইত্যাদির
ফলে যে ধ্বনির পরিবর্তন ঘটে, মূলত তাকেই বাংলা সন্ধি বলা হয়। খাঁটি বাংলা সন্ধি চলিত
ভাষার সম্পদ। বর্তমানে সাধু ভাষায়ও তার ব্যবহার চলে। কখনাে কখনাে সংস্কৃত সন্ধির নিয়ম
মেনেও বাংলা সন্ধি করা হয়। খাঁটি বাংলা সন্ধি দুই রকম স্বরসন্ধি ও ব্যঞ্জনসন্ধি। খাঁটি
বাংলায় বিসর্গসন্ধি হয় না, কারণ বিসর্গ লােপ করে তৎসম শব্দের স্বরান্ত উচ্চারণই বাংলা
ভাষার বৈশিষ্ট্য।
বাংলা স্বরসন্ধির সূত্র
১.
স্বর-লােপ: অ-কারান্ত
শব্দের পর এক অনির্দেশক প্রত্যয় থাকলে বাংলা উচ্চারণে অ-কার লুপ্ত হয় এবং এ-কার পূর্ববর্তী
হসন্ত বর্ণে যুক্ত হয়। যথা কত > ক + এক = কতেক, বার > বার + এক বারেক, তিল
> তিল্ + এক = তিলেক, আধ > আ + এক = আধেক, যত >যত্ + এক = যতেক, দশ > দশ
+ এক দশেক, শত > শত্ + এক শতেক, খান > খান্ + এক খানেক, অধ + এক = অর্ধেক ইত্যাদি।
২.
দুটি স্বর পাশাপাশি থাকলে
বাংলা উচ্চারণে আগে বা পরের যে কোন একটি স্বর লুপ্ত হয়। যথা একত্র + ইত একত্রিত (পূর্বস্বর-‘অ’
লােপ), কুড়ি + এক কুড়িক (পরবর্তী স্বর-‘এ’ লােপ), যা + ইচ্ছে তাই = যাচ্ছেতাই (পরের
সুর-‘ই’ লােপ), কোটি + এক = কোটিক, গুটি + এক মেয়ে। মেয়েলি, ছেলে + আমি ছেলেমি, ছােট
+ এর = ছােটর, আশি + এর আশির, ভাল + এর ভালর, মন্দ + এর মন্দের, বাদাম + ঈ। বাদামী,
গােলাপ + ঈ = গােলাপী, যাব + এখন = যাব’খন, দেব + এখন দেব’খন ইত্যাদি। = - গুটিক,
> + আলি > = > >
৩,
অ-কারান্ত শব্দের শেষে ‘ই’ বা ‘এ’ থাকলে
বাংলা উচ্চারণে অ-কার লােপ হয় এবং ই-কার বা ও-কার পুর্ববতী হসন্তবর্ণে যুক্ত হয়।
যথা তেমন > তেমন্ + ই = তেমনি, তখন > তখন + ই = তখনি, এমন > এম + ই = এমনি,
আমার > আমার + ও = আমারাে (আমারও), তােমার > তােমার + ও = তােমারাে (তােমারও),
তখন > তখন্ + ও তখনাে ইত্যাদি।
৪.
পূর্ব ও পরে আ-কার থাকলে
পরের আ-কার লুপ্ত হয়। যথা জেঠা + আমি = জেঠামি, রূপা + আলি = রূপালি, ন্যাকা + আমি
= ন্যাকামি, সােনা + আলি + সােনালি, পাকা + আমি = পাকামি, নােঙরা + আমি = নােঙরামি,
শাঁখা + আরি শাঁখারি ইত্যাদি।
৫.
স্বর-বিকৃতি: (ক)
অ, আ, এ, ও ইত্যাদি স্বরান্ত শব্দের পর ‘এ’ থাকলে বাংলা উচ্চারণে ‘এ’ বিকৃত হয়ে অন্তঃস্থ-‘য়’
হয়। যথা- ভাল + এ = ভালয়। (অ + এ > য়), পাতা + এ = পাতায় (আ + এ > য়), নদে
+ এ নদেয়, (এ এ > য়), আলাে + এ আলােয় (ও+ এ > য়) ইত্যাদি।
(খ) একাক্ষর শব্দের
শেষে আ, ই, উ, ও, আই থাকলে তার সঙ্গে যদি ‘এ’ যুক্ত হয়, তা হলে ‘এ’-বিকৃত হয়ে ‘য়ে
হয়। যথা মা + এ ঝি + এ = ঝিয়ে, দুই + এ দুইয়ে, শুই + এ শুইয়ে, ঘি + এ ঘিয়ে, দই
+ দইয়ে > দ’য়ে, মু (< মুখ) + এ মুয়ে, গু (মল) + এ গুয়ে, দু (< দুই) +
এ = দুয়ে পাে (ছেলে) + এ পােয়ে, ফুঁ + এ ছুঁয়ে, ভাই + এ ভাইয়ে ইত্যাদি।
৬.
সংস্কৃত সন্ধির অনুকরণে বাংলা সন্ধি:
(ক) বাপ + অন্ত বাপান্ত; দিল্লি + ঈশ্বর = দিল্লীশ্বর, ঢাকা + ঈশ্বরী = ঢাকেশ্বরী,
ঝুলন + উৎসব = ঝুলনােৎসব, আইন + অনুগ = আইনানুগ, উপর + উক্ত = উপরােক্ত, পােস্ট + আপিস
= পােস্টাপিস, হিসাব + আদি = হিসাবাদি, লােন (ঋণ) + আপিস = লােনাপিস, চাষ + আবাদ =
চাষাবাদ ইত্যাদি। অ-তৎসম শব্দের সঙ্গে তৎসম শব্দের সন্ধি, যা সংস্কৃত সন্ধির নিয়ম
বিরুদ্ধ কিন্তু বাংলায় সন্ধি করা হয়েছে।
(খ) তৎসম শব্দের শেষে
বিসর্গ থাকলে, তা লােপ করে স্বরান্ত উচ্চারণ বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্য। যথা মনঃ > মন,
যশঃ > যশ, বক্ষঃ > বক্ষ, শিরঃ > শির ইত্যাদি।
অতএব মন + অন্তর মনান্তর,
মন + আগুন মনাগুন, যশ + আকাঙক্ষা যশাকাঙক্ষা, বক্ষ + উপরি = বক্ষোপরি, শির + উপরি শিরােপরি
ইত্যাদি। এক্ষেত্রে বিসর্গ লােপ করে সংস্কৃত স্বরসন্ধির নিয়ম মানা হয়েছে।
বাংলা ব্যঞ্জনসন্ধির সূত্র
বাংলা ব্যঞ্জনসন্ধি
অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমীকরণ (সমীভবন), স্বরসঙ্গতি, বর্ণলােপ (স্বর ও ব্যঞ্জন) ইত্যাদি
ধ্বনি পরিবর্তনের নিয়মাধীন এবং মূলত-ই উচ্চারণ নির্ভর।
১.
ব্যঞ্জনের পূর্ববর্তী স্বরের লােপ।
যথা ভরা + পেট = ভরপেট, টাকা + শাল = টাকশাল, ঘােড়া + দৌড় = ঘােড়দৌড়, ঘােড়া +
সওয়ার ঘােড়সওয়ার, কাঁচা + কলা = কাঁচকলা, জোড়া + বাঁধা = জোড়বাঁধা > জোট্রাঁধা,
মিশি + কালাে মিকালাে, মাসী + শাশুড়ী = মাশাশুড়ী, উঁচু + কপালী = উঁচকপালী, পিছে
+ মােড়া। পিছুমােড়া ইত্যাদি।
২. বর্গের তৃতীয় ও
চতুর্থ বর্ণের আগে যদি বর্গের প্রথম বর্ণ থাকে, তাহলে বহুক্ষেত্রেই বগীয় প্রথম বর্ণটি
তৃতীয় বর্ণে রূপান্তরিত হয়।যথা এক + ঘা = এক্ঘা, পাঁচ পাঁজন, ছােট্ + দাদা ছােড়দাদা,
বট + গাছ। বড়গাছ, হাত + ধরা হারা, বাপ + ভাই। বাম্বাই এগৃঘা, + জন ইত্যাদি।
৩. সন্নিহিত দুটি ভিন্ন
জাতীয় ব্যঞ্জনের মধ্যে পরেরটি, আগেরটিকেসমজাতীয় রূপ দেয়। এটি পরাগত সমীভবনের নিয়মে
ঘটে থাকে।
গযথা। আর + না আন্না,
ঘােড়ার + ডিম ঘােড়ামি, কর + ছি কচ্ছি, সাত + জন = সাজ্জন, পাঁচ + সের = পাঁসের, চার
+ দিক = চাদ্দিক, চার + টি = চাট্টি, ভাত + দিয়ে = ভাদ্দিয়ে, যত + দিন। যদ্দিন, নাতি
> না + জামাই = নাজ্জামাই, এত + টুকু = এটুকু, হাত + টান এটুকু, হাত + টান = হাট্টান,
পাঁচ + শ পাঁশ, এক + গুন = এগুন, বদ + জাত = বজ্জাত, সাত + জন্ম = সাজ্জন্ম, । কর
+ তাল কত্তাল, বেটার + ছেলে = বেটাচ্ছেলে, ঘর + জামাই = ঘরজামাই বা ঘজ্জামাই ইত্যাদি।
৪. অনন্যান্য সমীভবনের
ফলে সন্নিহিত দুটি ধ্বনি পরিবর্তিত হয়। যথা বৎ + সর = বচ্ছর > বছর, কুৎ + সিত
> কুচ্ছিৎ, উৎ + সব = + । উচ্ছ (মহা + উচ্ছব = মােচ্ছব), চিকিৎ + সা = চিকিচ্ছা
ইত্যাদি।,
৫. বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে
স্বর লােপ ও ব্যঞ্জনের দ্বিত বা ব্যঞ্জন লােপ। যথা জুয়া > জুও + চোর জোচ্চোর, দুই
+ চার দুচ্চার, সাত + হাত সাথাত (হ লােপ), বােধ + হয় = বােধয় (হ-লােপ), জগৎ + বন্ধু
= জগবন্ধু (-লােপ), জগৎ + মােহন জগমােহন (ৎ-লােপ) ইত্যাদি।
[মনেরাখবেঃ খাঁটি বাংলাসন্ধিমূলত-ইউচ্চারণনির্ভর এবং কথ্য-ভাষায়
এর ব্যবহার বেশি। চলিত-ভাষা লেখা-পড়ায় স্বীকৃতি পাওয়ায়, খাঁটি বাংলা সন্ধির ব্যবহার
শিষ্ট ভাষায়-ও কিছু কিছু চলে আসছে।]