বাংলা ধ্বনি পরিবর্তনের কয়েকটি নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা (বাংলা ব্যাকরণ)
বাংলা ধ্বনি পরিবর্তনের কয়েকটি |
বাংলা
ধ্বনি পরিবর্তনের কয়েকটি নিয়ম
স্বর বা ব্যঞ্জন প্রত্যেক
বর্ণেরই নিজস্ব একটা উচ্চারণ বা ধ্বনি-রূপ রয়েছে। কিন্তু শব্দ বা বাক্যের মধ্যে যখন
ধ্বনিগুলি ব্যবহৃত হয় তখন তাদের নিজস্ব ধ্বনি-রূপ বা উচ্চারণ সর্বত্র অক্ষুন্ন থাকে
নাকোথাও তাদের বিকৃত উচ্চারণ হয় (অতুল>ওতুল), কোথাও বা লােপ পায় (অলাবু>লাউ),
কোথাও বা নতুন ধ্বনির আবির্ভাব ঘটে (স্কুল>ইস্কুল), আবার কোথাও শব্দের মধ্যে ধ্বনির
ক্রম ভঙ্গ করে আগে-পরে উচ্চারিত হয়ে যায় (আজি>আইজ ; পিশাচ>পিচাশ) . অর্থাৎ
ধ্বনির নানা রকমের পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তন যেমন খুশি তেমন ভাবে ঘটে না, বিশেষ বিশেষ
অবস্থায় বিশেষ বিশেষ কারণে পরিবর্তন ঘটে। কোন্ অবস্থায়, কোন্ ধ্বনির কী রকম পরিবর্তন
ঘটে তা বিশ্লেষণ করে ধ্বনি পরিবর্তনের নিয়ম বের করেছেন ভাষা-বিজ্ঞানীরা। নিচে ধ্বনি
পরিবর্তনের কয়েকটি সাধারণ নিয়ম আলােচনা করা হল
1.
স্বরভক্তি বা বিপ্রকর্ষ :
উচ্চারণের সুবিধার জন্য অথবা ছন্দের খাতিরে অনেক সময় সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনিকে ভেঙে
তার মধ্যে অ, ই, উ ইত্যাদি স্বরধ্বনি আনা হয়। এভাবে যুক্ত ব্যঞ্জনকে ভেঙে তার মধ্যে
স্বরধ্বনি আনার রীতিকে স্বরভক্তি বা বিপ্রকর্ষ বলে।
যথা (১) যুক্ত ব্যঞ্জন
ভেঙে ‘অ-কারের আগম জন্ম>জনম, ভক্তি>ভকতি, রত্ন>রতন, যত্ন>যতন ইত্যাদি।
(২) ‘ই’-কারের আগম প্রীতি>পিরীতি, শ্রী>ছিরি, মিত্র>মিত্তির, হর্ষ>হরিষ,
স্নান>সিনান ইত্যাদি। (৩) ‘উ’ -কারের আগম মুক্তা>মুকুতা, হৃ>ভুরু, ব্ল>
বুলু, বুশবুরুশ ইত্যাদি। (৪) যুক্ত ব্যঞ্জন ভেঙে ‘এ’-কার গ্রাম>গেরাম, শ্রাদ্ধ>ছেরাদ্দ,
গ্লাস>গেলা, ব্লেড>বেলেড়। (৫) যুক্ত ব্যঞ্জন ভেঙে ‘ও’-কার— শ্লোক>শােলােক,
মুর্গ (ফারসি শব্দ)>মােরােগ বা মােরগ, চক্র >চক্কোর ইত্যাদি।
2.
সমীভবন বা সমীকরণ (বা ব্যঞ্জনসঙ্গতি):
পদের মধ্যে পাশাপাশি অবস্থিত ভিন্ন-ভিন্ন ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের সময় একে অপরের প্রভাবে
দুটি একই ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়, অর্থাৎ দ্বিত্বব্যঞ্জনে পরিণত হয়, তখন তাকে সমীভবন
বা সমীকরণ বলে।
সমীভবন
তিন রকমের (১) পূর্ববর্তী
ধ্বনি পরবর্তী ধ্বনিকে পরিবর্তিত করলে তাকে প্রগত-সমীভবন বলা হয়। যথা- প>পক্ক,
পদ্ম>পদ্দ, গন্দা (চিংড়ি)>গল্লা, চন্দন>চন্নন ইত্যাদি। (২) পরবর্তী ধ্বনি
পূর্ববর্তী ধ্বনিকে পরিবর্তিত করলে, তাকে পরাগত-সমীভবন বলে। যথা- কর্ম (কম)>কম্ম,
ধর্ম>ধম্ম, কতদিন>কদ্দিন, আর কালী>আন্নাকালী। পরাগত সমীভবনের অনেক উদাহরণ
ব্যঞ্জনসন্ধিতে পাওয়া যায়। যেমন : উৎ+ জ্বল>উজ্জ্বল , তৎ+ জন্য>তজ্জন্য, শরৎ+চন্দ্র>শরচ্চন্দ্র
ইত্যাদি। (৩) পরস্পরের প্রভাবে দুটি ধ্বনি পরিবর্তিত হলে, তাকে অনন্যান্য-সমীভবন বলে।
যথাউৎ+ শাস>উচ্ছ্বাস, উৎ+ শৃঙ্খল>উদ্ধৃঙ্খল, তৎ+ হিত>তদ্ধিত ইত্যাদি।
সমীভবনের
বিপরীত ব্যাপার হল বিষমীভবন।
পদের মধ্যে পাশাপাশি অবস্থিত দুটি সম-ব্যঞ্জনের মধ্যে একটি বদলে যায় বাভিন্ন ব্যঞ্জনে
রূপান্তরিত হয়, একে বিষমীভবন বলে। বাংলার গ্রাম্য উচ্চারণে অনেক সময় এরকম ঘটে থাকে।
যেমন নাল, শরীর > শরীল, নােনা > লােনা (লবণযুক্ত)
3.
স্বরসঙ্গতি: মুখবিবরের মধ্যে জিভের অবস্থান অনুযায়ী মৌলিক স্বরধ্বনিগুলি
উচ্চে (ই, উ), মধ্যে (অ, এ, ও, অ্যা) ও নিম্নে (আ) অবস্থান করে। কোন পদের উচ্চারণ কালে
অনেকসময় উচ্চে অবস্থিত স্বরধ্বনিটি মধ্য বা নিমে অবস্থিত স্বরধ্বনিটিকে টেনে উপরে
তােলে অথবা নিম্নে বা মধ্যে অবস্থিত স্বরধ্বনিটি উচ্চে অবস্থিত স্বরধ্বনিটিকে টেনে
নিচে নামায়।
উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটি পরিষ্কার ‘বিলাতি’
কথাটিকে অনেক সময় আমরা বলি ‘বিলেতি’ বা ‘বিলিতি’ এখানে ‘আ’-নিম্নস্বরটি ডান ও বাঁ
পাশের দুটো উচ্চস্বর ‘ই’-র প্রভাবে বদলে মধ্যস্বর-‘এ’ বা উচ্চস্বর ‘ই’-তে পরিণত হয়েছে।
তাই বলা যায়, পদমধ্যস্থিত এক বা একাধিক স্বরধ্বনির প্রভাবে অন্য স্বরধ্বনি পরিবর্তিত
হয়ে যে উচ্চারণগত সমতা লাভ করে, তাকে স্বরসঙ্গতি বলে।
সাধুভাষা অপেক্ষা চলিত
ভাষাতেই স্বরসঙ্গতিজাত শব্দের প্রয়ােগ বেশি। কিভাবে উচ্চস্বরের প্রভাবে নিম্ন বা মধ্যস্বরের
এবং নিম্নস্বরের প্রভাবে উচ্চ বা মধ্যস্বরের পরিবর্তন ঘটে তা নিচে লক্ষ্য করাে
(১) উচ্চস্বরের প্রভাবে
মধ্য বা নিম্নস্বরের উচ্চে আরােহণ দেশি > দিশি (উচ্চস্বর ‘ই’-র প্রভাবে মধ্যস্বর
‘এ’ > উচ্চস্বর ‘ই’-তে পরিবর্তিত)। অনুরূপ উড়ানি > উড়ােনি > উড়নি (আ
> ও > উ), নিরাবিল > নিরিবিলি (আ > ই এবং অ > ই), ভিক্ষা > ভিক্ষে
(আ > এ), বিকাল > বিকেল, ফিতা > ফিতে, মূলা > মূলাে, পূজা > পুজো, কুমার
> কুমাের, বসু > বােসু ইত্যাদি। (২) নিম্নস্বরের প্রভাবে উচ্চ বা মধ্যস্বরের
নিম্নে অবরােহণ—লিখে > লেখে এখানে ‘এ’-মধ্যস্বরের প্রভাবে, ‘ই’ উচ্চস্বরটি, ‘এ’-এই
মধ্যস্বরে নেমে এসেছে। অনুরূপ(ই > এ), গিলে > গেলে (ই > এ), উড়ে > ওড়ে
(উ > ও) ইত্যাদি। বিড়াল >বেড়াল — এখানে ‘আ’-নিম্নস্বরের প্রভাবে ‘ই’-উচ্চস্বরটি
মধ্যস্বর-এ-তে রূপান্তরিত হয়েছে। অনুরূপ লিখা > লেখা (ই > এ), শুনা > শােনা
(উ > ও), শিয়াল > শেয়াল (ই> এ) ইত্যাদি। > মিশে > মেশে
4.
ধ্বনি বিপর্যয় (বর্ণবিপর্যয়) বা বিপাস: পদমধ্যস্থিত দুটি ধ্বনির স্থান পরিবর্তনকে বলে বিপাস বা
ধ্বনি বিপর্যয়। যেমন—পিশাচ > পিচাশ—এখানে পদমধ্যস্থিত ‘শ’ ও ‘চ’ এই ব্যঞ্জনবর্ণ
দুটি পরস্পর স্থান বদল করে ‘চ’ ও ‘শ’ উচ্চারিত হয়েছে; অথাৎ পদের মধ্যে তাদের অবস্থানের
ক্ষেত্রে বিপর্যয় ঘটে গেছে। অনুরূপ সংস্কৃত হ্রদ > দ্রহ > দহ, বড়িশ > বড়শি,
বারাণসী > বানারসী, মুকুট > মুটুক বা মটুক, বাক্স (box) > বাক, রিশ
(jinrickshaw>rickshaw) > রিকা, ডুবে > বুড়ে, কুফ (ফারসি) > কুলুপ, ডেস্ক
> ডেস্, ট্যাক্সি (taxi) > ট্যাকি ইত্যাদি। সাধারণত চলতি কথায় উচ্চারণ দোষেই
এই বিপর্যয় ঘটে, শুদ্ধ ভাষায় এ জাতীয় প্রয়োেগ বিশেষ একটা হয় না। তবে, বর্ণবিপর্যয়জাত
দু-একটি অশুদ্ধ শব্দ, বিশুদ্ধ শব্দের মর্যাদা লাভ করেছে; যেমন হ্রদ > দহ, বড়িশ
> বড়শি এবং সংস্কৃত হিন+ অ থেকে ‘সিংহ’ (‘হ’ ও ‘স’ পরস্পর স্থান বদল করেছে)। এবার
নিচের উদাহরণ দুটি লক্ষ্য করাে-কালি > কাইল, সাধু> সাউধ—এখানে ‘ই’-কার ঠিক জায়গায়
উচ্চারিত না হয়ে ব্যঞ্জনের আগেই উচ্চারিত হয়ে গেছে—এই যে স্থান বদল এ-ও একজাতীয়
বর্ণবিপর্যয়। বাংলা ব্যাকরণে এ জাতীয় বর্ণবিপর্যয়ের আলাদা নামকরণ করা হয়েছে অপিনিহিতি।
এ সম্পর্কে পরে বিস্তৃত আলােচনা করা হয়েছে।
5.
ধ্বন্যাগম (ধ্বনি+আগম) বা বণর্গম:
উচ্চারণের সুবিধার জন্য শব্দের আদিতে, মধ্যে বা অন্তে নতুন ধ্বনি বা বর্ণের আগম ঘটলে
তাকে ধ্বন্যাগম বা বগম বলে। স্বরের আগম ঘটলে স্বরাগম এবং ব্যঞ্জনের আগম ঘটলে ব্যাঞ্জনাগম।
স্বরাগম —(১) শব্দের
আদিতে সংযুক্ত বর্ণের পূর্বে—স্ত্রী > ইস্তিরি, স্পধা > আস্পর্ধা, স্কুল
> ইস্কুল, স্টেশন > ইস্টিশন, স্টেবল্ > আস্তাবল, স্টেট > এস্টেট ইত্যাদি।
(2) শব্দের মধ্যে নয়ন
> নয়ান, গাঁতি > গাঁইতি, রত্ন (রত্ন) > রতন ইত্যাদি। মনে রাখবে, স্বরভক্তি
বা বিপ্রকর্য আসলে পদমধ্যস্থ সংযুক্ত ব্যঞ্জনের মধ্যে স্বরধ্বনির আগম।
(3) শব্দের অন্তে সংযুক্ত
বর্ণের পরে স্বরধ্বনির আগম—সত্য > সত্যি, পথ্য> পথ্যি, দুষ্ট > দুষ্টু, বেঞ্চ
> বেঞ্চি, লিস্ট > লিস্টি, পিণ্ড > পিণ্ডি ইত্যাদি। ব্যঞ্জনাগম (১) শব্দের
আদিতে উজু > রুজু, ওঝা > রােজা, (২) শব্দের মধ্যে—অন্ন অম্বল, বানর > বান্দর,
(৩) শব্দের অন্তে স্কু > ইস্ক্রপ (এখানে আদিতে ‘ই’ এবং অন্তে ‘প’-এর আগম), ধনু
> ধনুক, এলা > এলাচ ইত্যাদি।
•
শ্রুতিধ্বনি য়-শ্রুতি ও ব-শ্রুতি
বাংলায় ধ্বন্যাগমের
আর এক প্রকার উদাহরণ তিধ্বনি। কোন শব্দের মধ্যে পাশাপাশি দুটি স্বরধ্বনি থাকলে তাদের
মধ্যে ব্যঞ্জনধ্বনির অভাব পূরণের জন্য অনেক সময় ‘য়’ (ইঅ) বা অন্তঃস্থ-ব (ওয়/উঅ)
এই ধ্বনি আমরা অসতর্কভাবে উচ্চারণ করে ফেলি। এইভাবে আগত ধ্বনিকে তিধ্বনি বলে। “য়’-এর
আগম হলে য়-শ্রুতি; আর অন্তঃস্থ-ব-এর আগম হলে, তাকে বলা হয় ব-শ্রুতি।
য়-শ্রুতি: মা+এর=মায়ের, লাঠি+ আল=লাঠিয়াল,
গাে+ আলা=গােয়ালা। অনেক ক্ষেত্রে ‘য়’ -ধ্বনি শােনা যায় কিন্তু বানানে লেখা হয় না।
যেমন কে এলাে (কানে শােনা যায়—“কেয়েলাে’), কি আর (কানে শােনা যায় ‘কিয়ার’), ওগাে
আমার (কানে শােনা যায়—“ওগােয়ামার’) ইত্যাদি।
ব-শ্রুতি: খাআ > খাওয়া, ঘােআ > ধােওয়া,
যাআ > যাওয়া, নাআ > নাওয়া, শূকর > অর > শুয়র।
6.
ধনিলােপ (বর্ণললাপ) বা বর্ণনাশ;
উচ্চারণের সুবিধার জন্য অনেকসময় পদমধ্যস্থ এক বা একাধিক ধ্বনির বিলােপ সাধন ঘটে, একে
ধ্বনিলােপ বা বর্ণনাশ বলে। শব্দ বা পদে স্বর ও ব্যঞ্জন উভয় ধ্বনিরই বিলােপ ঘটতে পারে।
স্বরধ্বনিলােপ- পদের কোন অক্ষরে প্রবল শ্বাসাঘাত
বা জোর পড়লে অনেক
সময় পদমধ্যস্থ কোন-কোন
স্বরধ্বনি লােপ পায়, একে স্বরলােপ বলে। (১) আদিতে স্বরলােপ অলাবু > লাউ (এখানে
‘ব’ ধ্বনিও লুপ্ত হয়েছে), অভ্যন্তর > ভিতর, এরন্ড > রেড়ী, উডুম্বর > ডুমুর,
উদ্ধার > ধার, অতসী > তিসি, অপিধান > পিধান ইত্যাদি। (২) মধ্যে স্বরলােপ—অতিথি
> অতিথ, সুবর্ণ > স্বর্ণ, ভগিনী > ভগ্নী, নাতিনী > নানী, নারিকেল >
নারকেল, জানালা > জালা, বসতি > বস্তি ইত্যাদি। (3) অন্তে স্বরলােপ— ফুল >
ফুল, জল > জল, রাত্রি > রাতি > রাত্, হাত > হাত। মনে রাখবে শব্দের শেষে
বাংলায় সাধারণত অ-কারের উচ্চারণ হয় না। (এ সম্পর্কে ইতিপূর্বেই বিস্তৃত আলােচনা করা
হয়েছে)।
ব্যঞ্জনধ্বনিলােপ - পদের ভিতরে অনেক সময় স্বরান্ত বা
হলন্ত ব্যঞ্জনধ্বনি লুপ্ত হয়, একে ব্যঞ্জনধ্বনিলােপ বলে। যথা ফাল্গুন (ফাগুন)
> ফাগুন, গােষ্ঠ > গােঠ, স্থান > থান, স্ফটিক > ফটিক, নবধর > নধর, অশ্বখ
> অশথ, বড়দিদি > বড়দি, মজদুর > মজুর, আলােক > আলাে, কাপাস > কাপাস,
ছোেটদিদি > ছােটদি বা ছােড়দি, দুগ্ধ > দুধ, হস্ত > হাত্ ইত্যাদি।
আদি অক্ষরে ব-ফলা (অন্তঃস্থ-ব),
ম-ফলা বাংলা বানানে বজায় থাকলেও উচ্চারণে লুপ্ত হয়। যেমন—দ্বারা, ধ্বনি, শ্বশুর,
শ্মশান, স্মৃতি ইত্যাদি। এ সম্পর্কে ইতিপূর্বে বিস্তৃত আলােচনা করা হয়েছে।
শব্দমধ্যবর্তী র-কার
বাংলা উচ্চারণে বহুস্থানে লুপ্ত হয়। যেমন—তর্ক (ত), ধর্ম (ধম্ম), কর্ম (কম্ম), শৃগাল
> শেয়াল, ত্রিপ্রান্তর > তেপান্তর।
হ-কারও বহুস্থলে লুপ্ত
হয়। যেমন—ফলাহার > ফলার, সিপাহি > সিপাই, বাদশাহ্ > বাদশা, তাহা > তা,
পুরােহিত > পুরুত, শিয়ালদহ > শিয়ালদা, বাহিরে > বাইরে ইত্যাদি।
অপিনিহিতি: ব্যঞ্জনের সঙ্গে যুক্ত ‘ই’-কার ও
‘উ’-কার শব্দের মধ্যে নিজস্ব জায়গায় উচ্চারিত না হয়ে ব্যঞ্জনটির ঠিক আগেই যদি উচ্চারিত
হয়ে যায়, তখন তাকে অপিনিহিতি বলে। যেমন ‘আজি’ কথাটির বর্ণ বিশ্লেষণ করলে পাই ‘আজ-ই’
অর্থাৎ “জ’-এর পরে ই-কার। কেউ যদি ‘জ’-এর ঠিক আগেই ‘ই’-কারটি উচ্চারণ করে বসে তা হলে
হয় আজি > আইজ। সাধু (সাল্ড) > সাউব ক্ষেত্রেও ‘ধ’-এর পরে ‘উ’-কার উচ্চারিত না
হয়ে ‘ধ’-এর ঠিক আগেই উচ্চারিত হয়েছে। আজি > আইজ, সাধু > সাউধ - অপিনিহিতি-র
উদাহরণ।
ই-কারের অপিনিহিতির
উদাহরণ কালি > কাইল, রাতি > রাইত, রাখিয়া >রাইখ্যা, কাটিয়া > কাইট্যা,
করিয়া > কইর্যা ইত্যাদি।
য-ফলা (ইয়) যুক্ত ব্যঞ্জনের
‘ই’ ব্যঞ্জনটির ঠিক আগে উচ্চারিত হয়ে অপিনিহিতি হয়।যেমন—সত্য (সত্তিয়) > সইত্ত,
কাব্য (কাবিয়) > কাইব্ব, যােগ্য > যােই, পথ্য > পইখ, বাহ্য > বাইজঝ ইত্যাদি।
উ-কারের অপিনিহিতির
উদাহরণ মাছুয়া > মাউছুয়া, সংস্কৃত ‘দীপবৃক্ষ > প্রাকৃতে ‘দিঅরূখা’ > বাংলায়।
দেউরখা (পিলসুজ), গাছুয়া > গাউছুয়া, জলুয়া >জউলুয়া ইত্যাদি। মনে রাখবে, পূর্ববাংলায়
(বর্তমানে বাংলাদেশ) কথ্য ভাষায় ‘ই’-কার ও ‘উ’-কারের অপিনিহিতি ঘটে। পশ্চিমবঙ্গের
উচ্চারণে এরূপ হয় না। লিখিত ভাষায় পূর্ববঙ্গে-ও অপিনিহিতির ব্যবহার চলে না।
অভিশ্রুতি: কোন শব্দের অপিনিহিতি-জাত ‘ই’-কার
বা উ-কার যদি পূর্ববর্তী স্বরের সঙ্গে মিলিত হয়, তা হলে পরবর্তী স্বরধ্বনির যে বিকার
বা পরিবর্তন ঘটে তাকে অভিশ্রুতি বলে। যথা ‘আসিয়া’ > অপিনিহিতি ‘আইস্যা’ অপিনিহিতি-জাত
‘ই’ পূর্ববর্তী স্বরধ্বনি ‘আ’-র সঙ্গে মিলিত হয়ে ‘এ’ ‘এস্যা। আ+ ই= ‘এ’-র প্রভাবে
পরবর্তী ‘অ’ বিকৃত বা পরিবর্তিত হয়ে হয়– এস্যে’ > এসে। এই পরিবর্তনকে অভিশ্রুতি
বলে। পশ্চিমবঙ্গের মৌখিক ভাষায় এই অভিশ্রুতি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়।
অভিশ্রুতির
আরাে উদাহরণ হাসিয়া
> হাইস্যা (অপিনিহিতি) > হেসে (অভিশ্রুতি), করিয়া > কইর্যা (অপিনিহিতি)
> করে > (অভিশ্রুতি), শুনিয়া শুইন্যা > শুনে, যাইয়া > যায়্যা > যেয়ে,
হাটুয়া > হাউটুয়া > হেটো, মাটি > মাইট্যা > মেটে, রাখিয়া > রাইখ্যা
> রেখে, মাছুয়া > মাউছুয়া > মেছাে, পানিহাটী > পাইনহাটী > পেনেটি,
মাতৃকা > মাইআ > মেয়ে ইত্যাদি।
মনে
রাখবে: অভিশ্রুতি
হল অপিনিহিতি, স্বরলােপ ও স্বরসঙ্গতির পরবর্তী ধাপ। কলকাতা ও ভাগীরথী তীরবর্তী অঞ্চলের
মানুষের কথ্যভাষায় অভিশ্রুতির লক্ষণটি স্পষ্ট। এই কথ্যভাষাকে আশ্রয় করেই বাংলা চলিত-ভাষার
উদ্ভব, তাই চলিত-ভাষায় অভিশ্রুতির প্রাধান্য।
•
নিচে ধ্বনি পরিবর্তনের আরাে কয়েকটি নিয়ম আলােচনা করা হল
১.
গুণ: ‘ই, ঈ’-স্থানে
‘এ’ বা ‘অয়’, ‘উ, উ’-স্থানে ‘ও’ বা ‘অব’ এবং ঋ’-স্থানে ‘অর’ হওয়াকে গুণ বলে। গুণ’
শুধু স্বরধ্বনির ক্ষেত্রেই হয়। যথা—লিখ > লেখ (ই > এ); নী > নয়ন (ঈ
> অয়); মুম্ > মােচন (উ > ও); ভূ > ভবন (উ > অব); — > শ্রবণ (উ
> অব); কৃ > করণ (ঋ > অর); বৃষ > বর্ষণ (ঋ> অর)।
২.
বৃদ্ধি : কোন-কোন
প্রত্যয় যােগ করলে মূল শব্দের ‘অ, আ’-স্থানে ‘আ’; ‘ই, ঈ, এ-স্থানে ‘ঐ; ‘উ, ঊ, ও-স্থানে
‘ঔ’ এবং ‘খ’-স্থানে ‘আ’ হওয়ার নাম বৃদ্ধি। যথা দরিদ্র > দারিদ্র্য (অ > আ);
আত্মা > আত্মিক (আ > আ); দিন > দৈনিক (ই > ঐ); দীন > দৈন্য (ঈ>ঐ);
বেদ > বৈদিক (এ > ঐ); ; সুমিত্রা > সৌমিত্রি (উ > ঔ); ভূমি > ভৌমিক
(উ > ঔ); লােক > লৌকিক (ও > ঔ); ভৃগু > ভার্গব (ঋ > আর); গুরু >
গৌরব (উ > ঔ– বৃদ্ধি, উ > অ— গুণ)।
৩.
সম্প্রসারণ : প্রত্যয়
যুক্ত হলে অনেক সময় ধাতুর আদ্যধ্বনির ‘য-স্থানে ‘ই’, ‘র’-স্থানে ‘ঋ’ এবং অন্তঃস্থ-‘ব’
-স্থানে ‘উ’ হয়, তাকে সম্প্রসারণ বলে। যথা Vযজ+তি-ইষ্টি (য > ই); Vগ্ৰহ্+ত=গৃহীত
(র > ঋ); Vস্ব+ তি=সুপ্তি, স্ব। Vবচ+ তি=উক্তি (ব> উ)।
৪.
আদেশ: প্রত্যয় যােগ করার সময় বা অন্য কারণে এক শব্দাংশের
স্থানে অপর শব্দাংশের বিধানকে আদেশ বলে। যথা বৃদ্ধ+ই=জ্যেষ্ঠ, এখানে প্রত্যয়ান্ত হওয়ার
সময়ে বৃদ্ধ’ শব্দটি ‘জ্য’ শব্দে পরিবর্তিত হল। অর্থাৎ ‘বৃদ্ধ’ স্থানে ‘জ্য’ আদেশ হল।
Vস্থা’-স্থানে ‘তিষ্ঠ’ ; Vদৃশ’-স্থানে ‘পশ্য’, ‘Vহন’-স্থানে ‘ঘাত’ আদেশ। রাজন্ঈয়=‘রাজনীয়’
নয়, হবে ‘রাজকীয়’ ‘ন’ স্থানে ‘ক’ আদেশ। Vআছ+ইবে= ‘আছিবে’ নয়, হবে ‘থাকিবে’ Vআছ’
স্থানে ‘Vথা’ আদেশ।