ভাষা ও ব্যাকরণ সম্পর্কে সহজেই জ্ঞান লাভ (বাংলা ব্যাকরণ)

dream
0

ভাষা ও ব্যাকরণ সম্পর্কে সহজেই জ্ঞান লাভ (বাংলা ব্যাকরণ)



ভাষা ও ব্যাকরণ

ভাষা: মানুষ সমাজে বাস করে এবং পরস্পরের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদানের জন্য ভাষা ব্যবহার করে থাকে। বুদ্ধি, কর্ম-কুশলতা ও ভাষা ব্যবহারের যােগ্যতাই মানুষকে মানুষ করে তুলেছে। আমরা যাকে ভাবনা-চিন্তা বলি তা-ও আসলে মনে মনে কথা বলা। এই ভাবনা-চিন্তাকে অন্যের কাছে ব্যক্ত করতে গেলে ভাষার সাহায্য নিতেই হবে। পশু-পাখিরা গলার আওয়াজে সঙ্গী-সাথীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে, কিন্তু তাদের গলার আওয়াজ ভাষা নয়। কারণ, চিন্তা-ভাবনা করে মনের কথা তারা ব্যক্ত করতে পারে না। তাদের গলার আওয়াজ কোন সচেতন প্রয়াস নয়, এ নিছকই স্নায়বিক উত্তেজনাজাত শরীরের তাৎক্ষণিক যান্ত্রিক অভিব্যক্তি। মানুষের ভাষা তার চিন্তার বাহন, এর মধ্যে রয়েছে তার সচেতন প্রয়াস। তাই মননশীল মানুষের কষ্ঠোচ্চারিত, সুনির্দিষ্ট অর্থযুক্ত ধ্বনি-সমষ্টিই ভাষা। আর মানুষ কথা বলে কণ্ঠ, জিহ্বা, তালু, মৃধা, ওষ্ঠ, দন্ত ইত্যাদির সাহায্যে, এদের একসঙ্গে বলে বাগযন্ত্র।

মাতৃভাষা: শিশু জন্মের পর মায়ের কোলে থাকতেই মায়ের মুখ থেকে শুনে যে ভাষায় কথা বলতে শেখে, তাই তার মাতৃভাষা। শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েই কথা বলতে আরম্ভ করে না। কোন নির্দিষ্ট জনগােষ্ঠীর অন্তর্গত কোন নির্দিষ্ট পরিবার-পরিবেশের মধ্যে থেকেই সে ধীরে ধীরে ভাষা আয়ত্ত করে।

ধ্বনি গেঁথেই আমরা অর্থযুক্ত শব্দ গঠন করি আর শব্দের মালা গেঁথে বাক্যের মধ্যে মনের ভাব প্রকাশ করি। কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে পৃথিবীর সর্বত্র একই রকম ধ্বনিসমষ্টি ব্যবহৃত হয় না। বিভিন্ন ভৌগােলিক অঞ্চলের জনগােষ্ঠী বিভিন্ন ধ্বনি-সমষ্টি গেঁথে কথা বলে থাকে, তাই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ভাষা লক্ষ্য করা যায়। একটা নির্দিষ্ট ধ্বনি-সমষ্টি দিয়ে যদি কোন জনগােষ্ঠী কথা বলে তাহলে তারা একই ভাষা-সম্প্রদায়ের অন্তর্গত বলে বিবেচিত হয়। যেমন বাংলা ভাষাভাষী মানুষ পশ্চিমবঙ্গ, স্বাধীন গণতন্ত্রী বাংলাদেশ, ত্রিপুরা, অসমের কিছু অংশে, বিহারের মানভূম-সিংভূম ইত্যাদি অঞ্চলে বা অন্যত্র বসবাস করলেও বাংলা ভাষা-সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। কারণ, তারা কথা বলবার সময় সকলেই একটা নির্দিষ্ট ধ্বনি-সমষ্টি ব্যবহার করে থাকে। এরা সকলেই একই ভাষা-সম্প্রদায়ের অন্তর্গত, এদের সকলেরই মাতৃভাষা বাংলা এরা বাঙালী।

বাংলা ভাষার জন্ম : মহামহােপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের পুঁথিশালা থেকে হিন-প্রায় একটি প্রাচীন পুঁথি উদ্ধার করেন এবং সেটি ১৯১৬ খৃঃ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়। পুঁথিটির প্রচলিত নাম ‘চর্যাপদাবলী’ শাস্ত্রী মশায় এর ভাষা বিশ্লেষণ করে দাবি করেন, এটি হাজার বছরের পুরনাে বাংলা ভাষার নিদর্শন। পরবর্তীকালে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও ভাষা-বিজ্ঞানের আলােকে বিচার করে এই মতই প্রতিষ্ঠিত করেন যে, বাংলা ভাষার জননী সংস্কৃত নয়, বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে মাগধী অপভ্রংশ ভাষা থেকে। আনুমানিক একহাজার বছর আগে মাগধী অপভ্রংশ ভাষা থেকে বাংলা, ওড়িয়া, অসমীয়া, মৈথিলী এই চারটি ভাষার উৎপত্তি হয়। জন্মের পর হাজার বছর ধরে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি ও ইংরেজি ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষার শব্দ ভাণ্ডার থেকে শব্দ গ্রহণ করে বাংলা ভাষা বর্তমান রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

বাংলা ব্যাকরণ : ভাষার স্বরূপ বিশ্লেষণ ও গঠন প্রণালী যে শাস্ত্রের বিষয় তাকে ব্যাকরণ বলে। ভাষা শুদ্ধভাবে লিখতে, পড়তে ও বলতে শেখার জন্যই ভাষার ব্যাকরণ জানতে হয়। ব্যাকরণ একটি সংস্কৃত শব্দ। যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল বি(বিশেষ) — আ (সম্যক) Vকৃ (করা) + অন – “বিশ্লেষণ, বিশেষরূপে এবং - সম্যরূপে বিশ্লেষণ করা। ইংরেজি Grammar শব্দটি গ্রীক ভাষা হইতে আসিয়াছে, ইহার অর্থ ‘শব্দশাস্ত্র’। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে ব্যাকরণ’ শব্দটি ইংরেজি Grammar-এর অর্থেই প্রযুক্ত হইয়া আসিয়াছে।” – (আচার্য সুনীতিকুমার)। বাংলা ব্যাকরণ সংস্কৃত । ব্যাকরণের মতাে শুধু শব্দ ব্যুৎপত্তি” শাস্ত্র নয়। বাংলা ব্যাকরণে ‘‘শব্দের ব্যুৎপত্তি ছাড়াও ইংরেজি গ্রামারের মতাে উচ্চারণ, শব্দের রূপ ও অর্থের বিশ্লেষণ, পদবিন্যাস, বাক্যগঠন ইত্যাদিও গৃহীত হয়েছে। তাই, আমরা বাংলা ব্যাকরণের সংজ্ঞার্থ নির্দেশ করে বলতে পারি যে শাস্ত্রে বাংলা ভাষার স্বরূপ ও গঠন প্রণালীর বিচার বিশ্লেষণ আছে এবং যে শাস্ত্রে জ্ঞান থাকলে বাংলা ভাষা শুদ্ধরূপে লিখতে, পড়তে ও বলতে পারা যায়, তাকে বাংলা ব্যাকরণ বলে।

বাংলা ভাষার বয়স প্রায় একহাজার বছর কিন্তু বাংলা ব্যাকরণের বয়স মাত্র দু’শ বছর। প্রথম বাংলা ব্যাকরণের রচয়িতা মাননা এল-দা-আস্ সুম সাম নামে একজন পর্তুগিজ পাদ্রী। এটি রােমান হরফে, বাংলা ভাষায় লেখা বাংলা পর্তুগিজ ব্যাকরণ ও শব্দকোষ। বইটি ১৭৪৩ খৃঃ, লিন্ শহরে ছাপা হয়। হ্যালহেড় নামে একজন ইংরেজ পণ্ডিত, ১৭৭৮ খৃঃ ইংরেজিতে লেখেন ‘দি গ্রামার অব দি বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ। ১৮২৬ খৃঃ রামমােহন ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ প্রথমে ইংরেজিতে লেখেন, পরবর্তীকালে বাংলায় অনুবাদ হয় এবং ১৮৩৩ খৃঃ তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। গৌড়ীয় ব্যাকরণের সূচনায় ব্যাকরণের সংজ্ঞার্থনির্দেশ করে রামমােহন লিখেছেন “ব্যাকরণ তাহাকে বলা যায় যাহার জ্ঞান দ্বারা উচ্চারণ শুদ্ধি, লিপিশুদ্ধি, অর্থাৎ যথাযােগ্য স্থানে পদ বিন্যাসের ক্ষমতা হয়। তারপর বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেছেন এবং তার সমস্যা নিয়ে আলােচনা করেছেন নকুলেশ্বর বিদ্যাভূষণ, যােগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ পরম শ্রদ্ধেয় ভাষাশাস্ত্রী পণ্ডিতেরা। কিন্তু বাংলা ব্যাকরণ এখনাে সংস্কৃত ব্যাকরণ ও ইংরেজি ‘গ্রামারের হাত ধরাধরি করেই চলেছে; প্রকৃত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ হয়ে ওঠেনি ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top