ব্যঞ্জনধ্বনি ও ব্যঞ্জনবর্ণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা (বাংলা ব্যাকরণ)

dream
0

 

ব্যঞ্জনধ্বনি ও ব্যঞ্জনবর্ণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

(বাংলা ব্যাকরণ)



ব্যঞ্জনধ্বনি ও ব্যঞ্জনবর্ণ

ব্যাঞ্জনধ্বনিঃ যে ধ্বনি স্বরধ্বনির সাহায্য ছাড়া একা একা উচ্চারিত হতে পারে না, তাকে ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। 

ব্যঞ্জনবর্ণঃ ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণ কালে নিঃশ্বাস বায়ু মুখ বিবরের এক বা একাধিক স্থানে বাধা পেয়ে নির্গত হয়। ব্যঞ্জনধ্বনির লিখিত রূপ বা চিহ্নকে ব্যঞ্জনবর্ণ বলে। বাংলায় ঊনচল্লিশটি ব্যঞ্জনবর্ণ আছে। 

যথা- ক, খ, গ, ঘ, ; চ, ছ, জ, ঝ, ঞ, ট, ঠ, ড, ঢ, ণ, ত, থ, দ, ধ, ন, প, ফ, ব, ভ, ম, য, র, ল, ব; শ, ষ, স, হ, ড়, ঢ়, য়; ং (অনুস্বার), (বিসর্গ), য়; ং (অনুস্বার), (বিসর্গ), (চন্দ্রবিন্দু)। শুদ্ধ ব্যঞ্জন (স্বরধ্বনি বিযুক্ত) ধ্বনি ‘’-কে বােঝানাের জন্য ‘’ খণ্ড-ত এই চিহ্নটিও ব্যবহার করা হয়।

শুদ্ধ ব্যঞ্জনবর্ণগুলিকে স্বরধ্বনি যুক্ত করেই উচ্চারণ করা যায়। যেমন ক, উ+ + অ = ঙ (উঁ অঁ, চ্+অ=চ, ই++অ= (ইআঁ), টু+অ = , ঞ ত্+অ ত, প+ অ = প, + অ = শ ইত্যাদি। 

ব্যঞ্জনবর্ণের শ্রেণীবিভাগ 

১. স্পর্শবর্ণ: ক থেকে ম্ পর্যন্ত পঁচিশটি ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণে জিভ মুখের ভিতরে নানা জায়গা (কণ্ঠ, তালু, মূধা, দন্ত) স্পর্শ করে বা উপরের ঠোঁটের সঙ্গে নিচের ঠোঁটের স্পর্শ ঘটে; তাই এদের স্পর্শবর্ণ বলে। উচ্চারণের স্থান অনুযায়ী স্পর্শবর্ণগুলিকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগগুলিকে বর্গ বলে। প্রত্যেক বর্গে পাঁচটি করে বর্ণ থাকে। প্রত্যেক বর্গের প্রথম বর্ণটির নাম ধরে, সেই বর্গের নামকরণ করা হয় যেমন- 

 

বর্গ

ব্যঞ্জনবর্ণ

ক-বর্গ

ক, খ, গ, ঘ, ঙ

চ-বর্গ

চ, ছ, জ, ঝ, ঞ

ট-বর্গ

ট, হ, ড়, ঢ, ণ

ত-বর্গ

ত, থ, দ, ধ, ন

পূ-বর্গ

প, ফ, ব, ভ, ম

২. উষ্মবর্ণ : শ, ষ, স, হ— এই চারটি উষ্মবর্ণ। ‘উষ্ম’ কথাটির অর্থ দাস, যতক্ষণ শাস থাকে ততক্ষণ ধরে এই বর্ণগুলির উচ্চারণ হয়। তাই, খাস বায়ুর প্রাধান্য যুক্ত বর্ণকেই উষ্মবর্ণ বলে।

৩. অন্তঃস্থবর্ণ : য (য়), র, ল, ব এই চারটি বর্ণের উচ্চারণের সময় নিঃশ্বাসবায়ু স্বরবর্ণের উচ্চারণের মতাে পুরােপুরি বিনা বাধায় বের হয় না আবার ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণের মতাে বাধাপ্রাপ্তও হয় না এরা “না-স্বর, না-ব্যঞ্জন’’ এবং স্পর্শবর্ণ ও উষ্মবর্ণের মাঝামাঝি এদের অবস্থান ; তাই এদের অন্তঃস্থ (মধ্যবর্তী) বর্ণ বলা হয়। এর মধ্যে ‘য’ ও ‘ব কে বলা হয় অর্ধস্বর এবং ‘র’ ও ‘ল’ কে বলা হয় তরল-স্বর।

৪. অযােগবাহ বর্ণ:ং (অনুস্বার) এবং (বিসর্গ) এই দু’টি অযােগবাহ বর্ণ বা আশ্রয়স্থানভাগী বর্ণ। কারণ, ব্যঞ্জন ও স্বরের সঙ্গে এদের কোন যােগ নেই (অ-যােগ), অথচ অন্য বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অর্থ বহন করে (বাহ) তাই এরা অযােগবাহ বর্ণ। এই বর্ণ দু’টি পূর্ববতী স্বরবর্ণের আশ্রয় ছাড়া উচ্চারিত হতে পারে না। তাই এদের আশ্রয়স্থানভাগীবর্ণ-ও বলা হয়।

৫. বাংলার নিজস্ব ব্যঞ্জনবর্ণ : ড়, ঢ়, য়, এবং (চন্দ্র বিন্দু)।

উচ্চারণরীতি অনুযায়ী বগীয় বর্ণের শ্রেণীবিভাগ

মহাপ্রাণ ও অল্পপ্রাণ বর্ণ: ‘প্রাণ’ কথাটির অর্থ “হাওয়া অর্থাৎ নিঃশ্বাস বায়ুর আধিক্য।

মহাপ্রাণ বর্ণঃ-  কোন বর্গীয় বর্ণের উচ্চারণে নিঃশ্বাস বায়ুর আধিক্য ঘটলেইবর্ণটি ‘হ’-ধ্বনি যুক্ত হয়ে উচ্চারিত হয়; তখন সেই বগীয় বর্ণকে মহাপ্রাণ বর্ণ বলা হয়।

প্রত্যেক বর্গের দ্বিতীয় ও চতুর্থ বর্ণ উচ্চারণের সময় প্রাণ অর্থাৎ নিঃশ্বাস বায়ু বেশি নির্গত হয় এজন্য এদের মহাপ্রাণ বর্ণ বলে। “হ্’-ধ্বনি যুক্ত হয়েই মহাপ্রাণ বর্ণগুলি উচ্চারিত হয়। ব্যাপারটি কিভাবে ঘটে একটু লক্ষ্য করাে ক্‌+হ্‌=খ্‌ , গ্‌+হ্‌ = ঘ্‌ , চ্‌+হ = ছ্‌, জ্‌+হ্‌ = ঝ্‌, ট্‌+হ, = ঠ্‌ , ড্‌+হ্‌ = ঢ্‌, ত্‌+হ্‌ + = থ্‌, দ্‌+হ্‌=ধ্‌,প্‌+হ্‌ =ফ্‌ , ব্‌+হ্‌ = ভ্‌ ,। খ্‌, ঘ্‌,ছ্‌ ,ঝ্‌ , ঠ্‌,ঢ্‌ ,থ্‌ ,ধ্‌ ,ফ্‌ , ভ্‌  এগুলি মহাপ্রাণ বর্ণ।

[মনে রাখবে: মহাপ্রাণ ধ্বনি অল্পপ্রাণ ধ্বনির মতাে উচ্চারিত হলে তাকে ক্ষীণায়ন বলে। যথা— মাথা > মাতা; চোখ > চোক; দেখছে > দেখচে; কাঠ > কাট; খাচ্ছি > খাচ্চি; হঠাৎ > হটাৎ; ধাই-মা > দাই-মা।]

অল্পপ্রাণ বর্ণঃ- কোন বর্গীয় বর্ণের উচ্চারণে প্রাণ বা নিঃশ্বাস বায়ু যদি বেশি নির্গত না হয়, তখন তাকে অল্পপ্রাণ বর্ণ বলে।

বর্গের প্রথম ও তৃতীয় বর্ণের উচ্চারণের সময় প্রাণ বেশি থাকে না অথাৎ নিঃশ্বাস বায়ু বেশি নির্গত হয় না, তাই এদের অল্পপ্রাণ বর্ণ বলে। যথা- ক্‌, গ্‌, ছ্‌, জ্‌, ট্‌,ড্‌ ,ত্‌ ,দ্‌ ,প্‌ , ব্‌ এরা অল্পপ্রাণ বর্ণ।

[মনে রাখবে: অল্পপ্রাণ ধ্বনি মহাপ্রাণ ধ্বনির মতাে উচ্চারিত হলে তাকে পীনায়ন বলে। যথা কাঁটাল>কাঁঠাল ; থুতু > থুথু; পুকুর > পুখুর ; গর্দভ > গর্ধভ; ‘ঢাক বাজে, ঢােল বাজে’ ‘ডাক বাজে, ডােল বাজে।]

ঘােষবর্ণ : ‘ঘােষ’ কথাটির অর্থ গুরু-গম্ভীর আওয়াজ। প্রতিবর্গের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম বর্ণটির উচ্চারণের সময় কণ্ঠস্বরে গুরু গম্ভীর আওয়াজ বা নাদের সৃষ্টি হয়, তাই এদের ঘােষবর্ণ বা নাদবর্ণ বলে। যথা- গ্‌, ঘ্‌,ঙ্‌ , জ্‌, ঝ্‌, ঞ্‌, ড্‌, ঢ্‌, ণ্‌, দ্‌, ধ্‌, ন্‌, ব্‌, ভ্‌, ম্।,

[মনে রাখবে: ঘােষধ্বনি অঘােষধ্বনির মতাে উচ্চারিত হলে তাকে অঘােষীভবন বলে। যথা–কাগজ > কাগচ, বীজ > বিচি, মদ্+ত= মত্ত > মত্ত ইত্যাদি।]

অঘােষবর্ণ: বর্গের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ণের উচ্চারণের সময় কণ্ঠ থেকে গাম্ভীর্যহীন : মৃদু আওয়াজ বের হয়, তাই এদের অঘােষ বর্ণ বলে। যথা- ক্, খ্‌,চ্‌ ,ছ্‌ ,ট্‌ , ঠ্‌, ত্‌, থ্‌,প্‌ ,ফ্‌ ।,

[মনে রাখবে: অঘােষধ্বনি ঘােষধ্বনির মতাে উচ্চারিত হলে তাকে ঘােষীভবন বলে। যথা – কাক > কাগ, শাক > শাগ, ধপধপে > ধবধবে, কতদূর > কদূর।]

অনুনাসিক বর্ণ: প্রত্যেক বর্গের পঞ্চম বর্ণ অর্থাৎ , ঞ, ণ, ন, ম, এবং অনুস্বার (ং)-এদের উচ্চারণের সময় নিঃশ্বাস বায়ুর বেশ কিছুটা নাক দিয়ে বের হয় (নাসিকার প্রাধান্য থাকে), তাই এদের নাসিক্যবর্ণ বা অনুনাসিক বর্ণ-ও বলা হয়।

অর্ধব্যঞ্জন: ‘ন্‌’, ‘ম্‌’ – দুটি বগীয় বর্ণ এবং,'র্‌’, ‘ল্‌’ – দুটি অন্তঃস্থ বর্ণকে অর্ধব্যঞ্জন বলা হয়। 

কারণ- এই চারটি ধ্বনি, স্বরধ্বনির ন্যায় একা একা বা ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে যুক্ত হয়ে অক্ষর (syllable) গঠন করতে পারে। 'ন্‌, ম্‌, র্‌, ল্' - ব্যঞ্জনবর্ণ হয়েও স্বরধ্বনির ন্যায় ব্যবহৃত হয়; তাই এদের অর্ধব্যঞ্জন বলে।

তবে বাংলা কোন শব্দে ‘ন, ম, র, ল’ অর্ধব্যঞ্জন রূপে ব্যবহৃত হয় না। সংস্কৃতে ঋ ও ৯ অর্ধব্যঞ্জন। ইংরেজি বা (Button), প্রিজম্ (Prism), ব্যাটু (Battle) ইত্যাদি শব্দে অর্ধব্যঞ্জন ‘, , – এর ধ্বনি শােনা যায়।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top