মাধ্যমিক ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় ৮ নম্বরের প্রশ্ন এবং উত্তর
মাধ্যমিক ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় ৮ নম্বরের প্রশ্ন এবং উত্তর |
1. উচ্চ শিক্ষা বিস্তারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা আলোচনা করো?
অথবা শিক্ষা ও জাতীয়তাবাদ প্রসারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান উল্লেখকর ?
ভূমিকাঃ-কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হল ভারতের আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং-এর আমলে 1857 খ্রিস্টাব্দে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাঁচে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়। লর্ড ক্যানিং 1857 খ্রিসটালের 24 শে জানুয়ারি ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আইন’ স্বাক্ষর করেন, ফলে এই দিনটিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবস বলা হয়।
প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য : 1854 খ্রিস্টাব্দের 19 জুলাই বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উড তার নির্দেশনামায় কলকাতায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। সেই অনুসারে 1857 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল—
শিক্ষার প্রসার ঘটানো: ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক্তিয়ারভুক্ত এলাকায় প্রজাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানোর কথা বলা হয়।
শিক্ষার বিভিন্ন শাখায় দক্ষতা নিরূপণ করা : কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হল সাহিত্য, বিজ্ঞান ও শিল্পকলার বিভিন্ন শাখায় পরীক্ষার মাধ্যমে সকল ছাত্রের দক্ষতা নিরূপণ করা।
কলেজ অনুমোদন, পরীক্ষাগ্রহণ, উপাধিদান : কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ছিল কলেজগুলিকে অনুমোদন দেওয়া, পরীক্ষা গ্রহণ করা ও উপাধি প্রদান করা।
পরিচালনা : কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য আচার্য ও উপাচার্য পদ এবং সিনেটের ব্যবস্থা করা হয়। সিনেট বা পরিচালন সভা 38 জন সদস্য নিয়ে গড়ে উঠেছিল। .
চ্যান্সেলার বা আচার্যঃ- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আচার্য ছিলেন ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং।
ভাইস চ্যাফেলার বা উপাচার্য : বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অন্যতম প্রধান পদ হল ভাইস চ্যান্সেলার বা উপাচার্য। ভাইস চ্যান্সেলারের পদটি ছিল অবৈতনিক। তিনি সিনেট ও সিন্ডিকেটের সুপারিশ অনুসারে মনোনীত হতেন। তাদের পরামর্শ নিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ পরিচালনা করতেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রথম উপাচার্য ছিলেন স্যার জেমস উইলিয়ম কোলভিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য ছিলেন স্যার গুরুদাস ব্যানার্জি।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্তিয়ারভুক্ত এলাকা : কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্তিয়ারভুক্ত এলাকা লাহোর থেকে রেঙ্গুন পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। 1882 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের 25 বছর পূর্তির সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্তিয়ারভুক্ত এলাকা হয়— লাহোর, পাতিয়ালা, সিমলা, দিল্লি, অমৃতসর, ইন্দোর, আগ্রা, আজমির, জয়পুর, কটক, ঢাকা, গুয়াহাটি, রেগুন প্রভৃতি। এর বাইরে সিংহল ও বার্মাতেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্তিয়ার ছিল।
কৃতী ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দঃ এই বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে বহু খ্যাতনামা ছাত্র-ছাত্রীগণ ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। 1858 সালে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও যদুনাথ বোস এখান থেকে প্রথম স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন এবং 1883 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা স্নাতক হন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি ও চন্দ্রমুখী বসু। এছাড়াও কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জি (1876), রাজেন্দ্রলাল মিত্র, মহেন্দ্রলাল সরকার (1898) আশুতোষ মুখার্জী(1908) প্রমুখ এখান থেকে বিভিন্ন বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
উনিশ শতকের শেষ দিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ছাত্রসংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রগতির বিষয় পর্যালোচনার জনা লর্ড রিপন 1882 খ্রিস্টাব্দে হান্টার কমিশন’ নিয়োগ করেন। হান্টার কমিশন তার রিপোর্টে প্রাথমিক শিক্ষা, নারীশিক্ষা ও বিজ্ঞান শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করে। যাই হোক, 1901-1902 খ্রিস্টাব্দে বাংলায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজ শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটে। বিদ্যমান 72টি কলেজের উপর কলকাতায় আরও 20টি এবং সমগ্র বাংলাদেশে 26টি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ এর প্রেক্ষিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য ।এই বিশ্ববিদ্যালয়ের
কৃতী ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ বাংলায় নবজাগরণ কে সমৃদ্ধ করেছিলেন। সেই সময় এটি ছিল ভারতের সর্ববৃহৎ ও সর্বোৎকৃষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়; শুধু তাই নয় এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
2. উনিশ শতকের বাংলায় নবজাগরণের চরিত্র,প্রকৃতি ও বিতর্ক সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা নবজাগরনের সংজ্ঞা দাও এবং এর চরিত্র প্রকৃতি ও বিতর্ক সম্পর্কে আলোচনা কর।
ভুমিকাঃ রেনেসাঁস একটি ফরাসি শব্দ। এর বাংলা অর্থ হল নবজাগরণ। রেনেসাঁস শব্দটি ইউরোপে বিশেষত ইটালির ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত। এই শব্দের দ্বারা মূলত 14-16 শতকের ইতালীয় সাহিত্য, শিল্পকলা, বিজ্ঞান ও রাজনীতির স্ফুরণকে বোঝায়। অপদিকে পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে এসে উনিশ শতকের মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে এক যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী আড়োলনের সুচনা হওয়ার ফলে তৎকালীন ধর্ম,সমাজ,শিক্ষা,সাহিত্য,দর্শন,রাজনীতি-জীবনের সর্বক্ষেত্রেই ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়, যাকে ঐতিহাসিকরা ‘বঙ্গীয় নবজাগরণ’ বা ‘Bengal Renaissance’ বলে অভিহিত করেছেন।
নবজাগরনের স্রষ্টাঃ-নবজাগরন স্রষ্টা কারা এ নিয়ে বিতর্ক আছে। পশ্চিমের জ্ঞান বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ, দর্শন, মানবতাবাদ, উদারনীতি প্রভৃতি বাঙালি মনোজগতে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনেছিল আর এই পরিবর্তনের ফলে নবজাগরণের সূত্রপাত হয়েছিল। বাংলার নবজাগরণের অন্যতম দিকছিল হিন্দু ধর্মের সংস্কার সাধন।রাজা রামমোহন রায়,দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতা, পুরোহিততন্ত্র ও আচারসর্বস্বতাকে দূর করতে চেয়েছিলেন। মার্কিন গবেষক ডেভিড কফ মনে করেন যে, উইলিয়াম জোন্স,জোনাথন ডানকান এবং কোলব্রুকের মত ব্যক্তিদের প্রচেষ্টাতেই বাংলায় নবজাগরণ ঘটেছিল। তিনি আরো মনে করেন,বাংলার নবজাগরনে এশিয়াটিক সোসাইটি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রভূতি প্রতিষ্ঠান বিশেষ ভূমিকা ছিল। যাইহোক রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেন যে, পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে এসে দেশবাসীর অভ্যন্তরে মানবতাবাদ ও যুক্তিবাদের স্ফুরোন ঘটে এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভাবধারার সমন্বয়ের ফলে নবজাগরণের সূচনা হয়। ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী বলেন যে, পশ্চিম ও পূর্বের বীজের শংকর ভারতের মাটিতে পড়ে যে ফসল ফলিয়েছে তাই হলো নবজাগরণের ভিত্তি।
বাংলার নবজাগরণের চরিত্র ও প্রকৃতি: উনিশ শতকে বাংলাদেশের নবজাগরণের চরিত্র বা প্রকৃতি বিষয়ে বিভিন্ন মতামত আছে।
বাংলার নবজাগরণ : তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রাজা রামমোহন রায় এক চিঠিতে আলেকজান্ডার ডাফকে লিখেছিলেন, আমি ভাবতে শুরু করেছি যে, “ইউরোপীয় রেনেসাঁসের মতো কিছু একটা ভারতে ঘটতে চলেছে”। রামমোহনের মত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কেশবচন্দ্র সেন, বিপিনচন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উনিশ শতকের বাংলার মানসিক স্ফুরণ ও সংস্কার আন্দোলনকে নবজাগরণ বলেছেন।
ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার তার ‘বাংলার ইতিহাস' গ্রন্থে উনিশ শতকের বাংলাকে নবজাগরণের পীঠস্থান’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, “কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর ইউরোপে যে নবজাগরণ দেখা যায়, উনবিংশ শতকে বাংলার নবজাগরণ ছিল তার থেকেও ব্যাপক, গভীর এবং বৈপ্লবিক।”
অধ্যাপক সুশোভন সরকার বলেছেন যে, বাংলাদেশেই সর্বপ্রথম ব্রিটিশ শাসনে বুর্জোয়া অর্থনীতি ও আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব অনুভূত হয়। তার ফলে যে সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটে তাকে সাধারণভাবে নবজাগরণ বলা হয়ে থাকে। ইউরোপীয় নবজাগরণের সেই ভূমিকা পালন করেছিল বাংলা (তৎকালীন বাংলাদেশ)।
বাংলার নবজাগরণ প্রকৃত নবজাগরণ নয় : অনেকে বাংলার নবজাগরণের কথা স্বীকার করলেও অনেকে আবার একে প্রকৃত অর্থে নবজাগরণ বলতে রাজি নন।
তথাকথিত নবজাগরণঃ-প্রখ্যাত পণ্ডিত অশোক মিত্র ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে আদমশুমারি বা Census তৈরির সময় বাংলায় উনিশ শতকের জাগরণকে “তথাকথিত নবজাগরণ” (so called
Renaissance) বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবাদে নয়া জমিদারশ্রেণি সাধারণ রায়তদের শোষণ করে যে বিপুল অর্থ লাভ করেছিল তার একটা বিরাট অংশ তারা কলকাতার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্যয় করেছিলেন। এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনও যোগ ছিল না।
ইউরোপীয় নবজাগরণের সমতুল্য নয় : গবেষক সুপ্রকাশ রায় বলেছেন, বাংলায় সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রকৃতি ছিল ইউরোপের আন্দোলন থেকে ভিন্ন এবং বিপরীতমুখী। তিনি বলেছেন, আমাদের আধুনিক যুগের লেখকগণ ইউরোপের অনুকরণে সোহাগভরে বাংলার নগরকেন্দ্রিক আন্দোলনটির নাম দেয় নবজাগরণ। ইউরোপের নবজাগরণ ছিল সামন্তপ্রথার বিরুদ্ধে; কিন্তু বাংলার নবজাগরণ ছিল জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীদের সাথে একত্রিত হয়ে সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামীদের আন্দোলন। আবার বাংলার বিশাল কৃষকশ্রেণি ছিল ভূস্বামীদের শত্রু ও বিরোধী।
ঐতিহাসিক প্রতারণাঃ ঐতিহাসিক বিনয় ঘোষ তার ‘বাংলার নবজাগৃতি’ গ্রন্থে বলেছেন উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ ছিল একটি মিথ্যাচার।নবজাগরণ কে তিনি একটি ঐতিহাসিক প্রতারণা বলে অভিযোগ করেছেন। অরবিন্দ পোদ্দার, ডঃ বরুন দে, ডঃ অশোক সেন এবং সুমিত সরকারও ঠিক অনুরূপ বক্তব্য রেখছেন। অরবিন্দ পোদ্দার এর মতে উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ ছিল ‘একটি বিকৃত ও নীরস নবজাগরণ’
নবজাগরণের গুরুত্ব: উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে পারি যে,নানা দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও উনিশ শতকে নবজাগরণের ফলে ভারতীয়রা পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ পায়। এছাড়াও বাংলার সমাজ ধর্ম ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে এই নবজাগরণ কিছুটা পরিবর্তন এনেছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই।জনৈক জার্মান সমাজতত্ত্ববিদের মতে, ভারতে নবজাগরণের মাধ্যমে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগের সূচনা ঘটেছিল।
3.বাংলায় ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও । এই আন্দোলনের গুরুত্ব কী ছিল ?
অথবা উনিশ শতকের বাংলায় ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনের বিবর্তন ও ব্রাহ্ম সমাজের বিভাজন সম্পর্কে আলোচনা কর।
উনিশ শতকের বাংলায় ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনের বিবর্তন ও ব্রাহ্ম সমাজের বিভাজন সম্পর্কে আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ- উনিশ শতকে বাংলা তথা ভারতের ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলনের পথিকৃৎ ছিল ব্রাহ্মসমাজ। ব্রাহ্মসমাজ একেশ্বরবাদের কথা প্রচার করে। রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগে ব্রাহ্মসমাজ গঠিত হয়; কিন্তু পরবর্তীকালে এর বিবর্তন ও বিভাজন ঘটে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে ‘আদি ব্ৰাহ্মসমাজ’, কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ’, ‘নববিধান ব্রাহ্মসমাজ’ এবং শিবনাথশাস্ত্রী ও আনন্দমোহন বসুর নেতৃত্বে ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’ গড়ে ওঠে।
ব্রাহ্সমাজ প্রতিষ্ঠা:- রাজা রামমোহন রায় উপনিষদের একেশ্বরবাদী তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে 1828 খ্রিস্টাব্দে ব্রাত্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন। এটি পরবর্তীকালে(1830 খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিত হয়।
প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য : রাজা রামমোহন রায়ের ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল—
i)এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্মেরউপাসনা করা।
ii)খ্রিস্টান মিশনারিদের আক্রমণের হাত থেকে হিন্দুধর্মকে রক্ষা করা।
iii)বাংলায় বৈদান্তিক হিন্দুধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
iv)হিন্দুধর্মের নামে যেসব কুসংস্কার ও অন্যায়-অবিচার প্রচলিত আছে তার উচ্ছেদ করা।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ব্রাহ্মসমাজে বিবর্তন: রাজা রামমোহনের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মসমাজ ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যোগদানের ফলে ব্রাত্ম আন্দোলনে নতুন প্রাণের সাঞ্চার হয় এবং ব্রাহ্ম সমাজ আবার গতিশীল ওঠে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সবচেয়ে বড় অবদান হল তিনি ব্রাহ্মসমাজের নিয়মাবলি, ধর্ম, আচারবিধি, ক্রিয়াপদ্ধতি প্রভৃতি প্রণয়ন করেন। তার এই কাজের ফলে ব্রাহ্ম আন্দোলন একটি সাংগঠনিক রূপ পায়। তিনি ব্রাত্মধর্ম প্রচারে উদ্যোগী হন। যাইহোক ব্রাহ্মসমাজ সাংগঠনিক রূপ লাভ করার পর ব্রহ্মরা একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায়ে পরিণত হয় এবং তিনি বেদের অভ্রান্ততা অস্বীকার করার ফলে হিন্দুধর্মের সঙ্গে ব্রাত্মধর্মের দূরত্ব বাড়তে থাকে।
কেশবচন্দ্র সেন ওব্রাহ্মসমাজের বিবর্তন:- 1857 খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করলে ব্রাত্ম আন্দোলন আরও গতিশীল হয়। তার বাগ্মিতা, ধর্মোন্মাদনা ও নিষ্ঠায় মুগ্ধ শিক্ষিত যুবকরা দলে দলে ব্রাহ্ম সমাজে যোগদান করে। তার সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর 1862 খ্রিস্টাব্দে তাকে ‘ব্ৰত্মানন্দ’ উপাধি দেন। তিনি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক ও আচার্য হন।1865 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলায় 50টি এবং সারা ভারতে মোট 54টি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়।
ব্রাহ্ম সমাজের প্রথম বিভাজনঃ-
ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ ও আদিব্রাহ্মসমাজ: কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্ম উপাসনা পদ্ধতি ও ব্রাহ্মধর্মের মূল তত্ত্বগুলিকে সহজসরল ও যুগোপযোগী করে তোলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলতেন ব্রাহ্ম ধর্ম হল হিন্দুধর্মই এবং হিন্দুধর্মের বিশুদ্ধ রপ। তিনি মূর্তিপূজা অথবা হিন্দুধর্মের অন্য কোন সংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলেন না। অপরদিকে কেশবচন্দ্র সেন হিন্দুধর্ম ও সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধেও আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলেন। এই মতপার্থক্যের জন্য ব্রাহ্ম সমাজ ভেঙে যায়। কেশবচন্দ্র সেন 1866 খ্রিস্টাব্দে ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং দেবেন্দ্রনাথ ও তাঁর অনুগামীদের ব্রাহ্মসমাজ ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ’ নামে পরিচিতি লাভ করেন।
ব্রাহ্ম সমাজের দ্বিতীয় বিভাজনঃ-
সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ:-কিছুদিনের মধ্যে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে বিভেদ ঘটে। কেশবচন্দ্রের চৈতন্যপ্রীতি, খ্রিস্টপ্রীতি, হিন্দু দেবদেবী ও অনুষ্ঠানের প্রতি বিশ্বাস ব্রাহ্ম সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তিনি বাল্যবিবাহের বিরোধিতা করলেও নিজের 14 বছর বয়সি কন্যা সুনীতিদেবীর সঙ্গে কোচবিহারের নাবালক রাজপুত্র নৃপেন্দ্রনারায়ণের বিবাহ দিলে তরুণ ব্রাহ্মরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তরুণ ব্রাহ্মনেতা শিবনাথ শাস্ত্রী,আনন্দমোহন বসু, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় 1878 খ্রিস্টাব্দের 15 মে ‘সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন।
ব্রাহ্ম সমাজের তৃতীয় বিভাজনঃ-
নববিধান ব্ৰাহ্ম সমাজ :- কেশবচন্দ্র সেন 1880 খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিখ্যাত নববিধান প্রচার করেন। এর মাধ্যমে তিনি সর্বধর্মসমন্বয়ের আদর্শ প্রচার করেন। কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে পরিচালিত ব্রাহ্ম সমাজ ‘নববিধান ব্রাত্মসমাজ’ নামে পরিচিত হয়।
উপসংহারঃ- কেশবচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত ব্রাহ্ম সমাজ তার প্রভাব-প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেলে। তবে বাংলার ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলনে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, “কেশবচন্দ্র পরিচালিত এই ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলনই হল প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলন।”
5. এদেশে চিকিৎসাবিদ্যার
ক্ষেত্রে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের কীরূপ ভূমিকা ছিল?
ভূমিকাঃ- ভারতে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যা বা আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার অগ্রগতিতে কলকাতা ডিক্যাল কলেজের ভূমিকা বেশগুরুত্বপূর্ণ ছিল। গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের রাজত্বকালে 1835 খ্রিস্টাব্দে এই কলেজটির প্রতিষ্ঠা হলে এক নবযুগের সূচনা হয়।
প্রেক্ষাপটঃ- ইতিপূর্বে স্থাপিত হওয়া ‘স্কুল ফর নেটিভ ডক্টরস’ (১৮২২ খ্রিস্টাব্দ), সংস্কৃত কলেজ অব আয়ুর্বেদ (১৮২৬ খ্রিস্টাব্দ) ও ‘কলকাতা মাদ্রাসা ইউনানি’র শিক্ষাগত মান যাচাই করার জন্য বেন্টিঙ্ক একটি কমিশন গঠন করেন। মি. জে গ্র্যান্ট-এর নেতৃত্বে (১৮৩৩ খ্রিঃ) গঠিত হওয়া এই কমিশন ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২০ অক্টোবর একটি রিপোর্ট পেশ করেন। এতে সংস্কৃত, আরবি-ফারসি ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার সুপারিশ করা হয়।এই সুপারিশের ভিত্তিতে বেন্টিঙ্ক ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জানুয়ারি গড়ে তোলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ।
উদ্দেশ্যঃ- জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভারতীয় যুবকদের আধুনিক পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যায় দক্ষ করে তোলা, দেশের বিভিন্ন চিকিৎসাকেন্দ্রে দক্ষ ডাক্তার ও নার্সের জোগান দেওয়াই ছিল এই কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য।
শিক্ষকমণ্ডলীঃ- মতিলাল শীল-এর দান করা জমিতে গড়ে ওঠে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ। ডাঃ এম জে ব্রামলি ছিলেন এই কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ। ডাঃ মধুসূদন গুপ্ত, ডাঃ এইট গুডইভ ছিলেন এই কলেজের শিক্ষক।
পঠন-পাঠনঃ- ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি ৪৯ জন ছাত্রকে নিয়ে এর পঠন-পাঠন শুরু হয়। ভেষজ, অঙ্গ ব্যবচ্ছেদবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, ঔষধের গুণাগুণ ও প্রয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা করা হয়। ১৮৪৫ খ্রি: ইংল্যান্ডের রয়্যাল কলেজ অব সার্জেন-এর পাঠক্রম এখানে অনুসৃত হয়।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে এই মেডিকেল কলেজ তার অনুমোদন লাভ করে। এই কলেজের মেধাবী ছাত্রদের ইংল্যান্ডে প্রেরণ করে প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা হয়।
শব ব্যবচ্ছেদঃ- পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম অঙ্গ হল শব ব্যবচ্ছেদ। ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের ২৮ অক্টোবর মধুসূদন গুপ্ত শব ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়ে এক যুগান্তকারি নজির সৃষ্টি করেন। তাঁকে সাহায্য করেন উমাচরণ শেঠ, রাজকৃয় দে, দ্বারকানাথ গুপ্ত ও নবীনচন্দ্র দে প্রমুখ।
উপসংহারঃ- ভারতে চিকিৎসাশিক্ষার ইতিহাসে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অবদান অপরিসীম। এটি ছিল এশিয়া মহাদেশের ও দ্বিতীয় কলেজ। ধনী ও শিক্ষানুরাগী রামকমল সেন, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখের আর্থিক সহায়তায় হাসপাতাল ও কলেজের নতুন গৃহ নির্মিত হয়।এর চিকিৎসা পরিসেবা ও চিকিৎসা-গবেষণা ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করে।
6. উনিশ শতকের বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব কেন ঘটে এর পরিণতি কি হয়?
অথবা
প্রাচ্য শিক্ষা-পাশ্চাত্য শিক্ষা বিষয়ক দ্বন্দ্ব কী? ভারতে ইংরেজী শিক্ষার প্রসার কিভাবে হয়ে আলোচনা কর।
অথবা
উনিশ শতকে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার কিভাবে হয়েছিল তা সংক্ষেপে আলোচনা কর।
অথবা
ভারতের ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ও সরকারী শিক্ষা নীতি হিসাবে ইংরেজি শিক্ষা বা পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণের পটভূমি আলোচনা কর।
প্রাচ্য শিক্ষা-পাশ্চাত্য শিক্ষা বিষয়ক দ্বন্দ্বঃ- ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্টে এদেশের শিক্ষাখাতে প্রতি বছর বরাদ্দ করা একলক্ষ টাকা প্রাচ্য না পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে খরচ করা হবে সে সম্পর্কে ১৮২০-র দশকে ইংরেজ পণ্ডিতদের মধ্যে এক তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়,তাদের মধ্যে একদল চাইতেন, ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে ভারতীয়দের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে। এঁরা পাশ্চাত্যপন্থী বা অ্যাংলিসিস্ট নামে পরিচিত ছিলেন। অপরদল চাইতেন, ভারতীয়দের দেশের ঐতিহ্য, ভারতীয় শিক্ষা, সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবান করে গড়ে তুলতে। এঁরা ভারতীয় শিক্ষাপদ্ধতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করে তা ভারতীয়দের মধ্যে প্রসারিত করার সংকল্পে ব্রতী ছিলেন। এঁরা প্রাচ্যপন্থী বা ওরিয়েন্টালিস্ট নামে পরিচিত ছিলেন। চার্লস গ্রান্ট, ট্রাভেলিয়ান, লর্ড মেকলে প্রমুখ ছিলেন পাশ্চাত্য পন্থী, অন্যদিকে এইচ টি প্রিন্সেপ, কোল ব্রুক, উইলসন ছিলেন প্রাচ্যপন্থী। ভারতে ইংরেজি শিক্ষাপ্রসার সংক্রান্ত দ্বন্ধে চার্লস গ্রান্টের সঙ্গে কোম্পানির ডিরেক্টর সভার সদস্যদের মতবিরোধ চরম পর্যায়ে পৌছেছিল।
আঠারো শতকের দ্বিতীয় ভাগে ভারতে যখন ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সে সময় ভারতে দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থা চালু ছিল। শাসনব্যবস্থার সূচনায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজ্য বিস্তার ও শাসনতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণে বেশি মনোযোগী হয়েছিল-শিক্ষা ক্ষেত্রে দৃষ্টি পড়েছিল অনেক পরে।যাইহোক বাংলা থেকেই পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচলন শুরু হয় এবং উইলিয়াম বেন্টিং এর আমলে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তিত হয়(১৮৩৫) সালে
ইংরেজি শিক্ষার প্রসারঃ-.
বেসরকারি উদ্যোগঃ- উনিশ শতকে বাংলায় বেসরকারি উদ্যোগে। শিক্ষাপ্রসারে
উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়, রাজা রাধাকান্ত দেব, বর্ধমানের রাজা তেজচন্দ্র রায়বাহাদুর, ডেভিড হেয়ার প্রমুখ। রামমোহন রায়ের উদ্যোগে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল গড়ে ওঠে। ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ জানুয়ারি কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কলেজ ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজ নামে পরিচিত হয়। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি।
খ্রিস্টান মিশনারিদের অবদানঃ-উনিশ শতকে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে মিশনারিরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যান, উইলিয়াম ওয়ার্ড এই তিন শ্রীরামপুর ত্রয়ী'-র উদ্যোগে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। বর্তমানে এটি ‘শ্রীরামপুর কলেজ' নামে পরিচিত। আলেকজান্ডার ডাফের উদ্যোগে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন, ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ‘সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, শিবপুরে ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে বিশপস কলেজ প্রভৃতি গড়ে ওঠে।
সরকারি উদ্যোগঃ- ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের ‘চার্টার আইনে’ ভারতে শিক্ষাবিস্তারের জন্য ১ লক্ষ টাকা ব্যয় করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এই অর্থ প্রাচ্য শিক্ষা না পাশ্চাত্য শিক্ষাখাতে ব্যয় করা হবে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব বাধে। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্টে এদেশের শিক্ষাখাতে প্রতি বছর বরাদ্দ করা একলক্ষ টাকা প্রাচ্য না পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে খরচ করা হবে সে সম্পর্কে ১৮২০-র দশকে ইংরেজ পণ্ডিতদের মধ্যে এক তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়,তাদের মধ্যে একদল চাইতেন, ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে ভারতীয়দের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে। এঁরা পাশ্চাত্যপন্থী বা অ্যাংলিসিস্ট নামে পরিচিত ছিলেন। অপরদল চাইতেন, ভারতীয়দের দেশের ঐতিহ্য, ভারতীয় শিক্ষা, সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবান করে গড়ে তুলতে। এঁরা ভারতীয় শিক্ষাপদ্ধতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করে তা ভারতীয়দের মধ্যে প্রসারিত করার সংকল্পে ব্রতী ছিলেন। এঁরা প্রাচ্যপন্থী বা ওরিয়েন্টালিস্ট নামে পরিচিত ছিলেন। চার্লস গ্রান্ট, ট্রাভেলিয়ান, লর্ড মেকলে প্রমুখ ছিলেন পাশ্চাত্য পন্থী, অন্যদিকে এইচ টি প্রিন্সেপ, কোল ব্রুক, উইলসন ছিলেন প্রাচ্যপন্থী। ভারতে ইংরেজি শিক্ষাপ্রসার সংক্রান্ত দ্বন্ধে চার্লস গ্রান্টের সঙ্গে কোম্পানির ডিরেক্টর সভার সদস্যদের মতবিরোধ চরম পর্যায়ে পৌছেছিল।
প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্বের পরিণতিতে সরকার কর্তৃক টমাস ব্যাবিংটন মেকলের শিক্ষা বিষয়ক প্রস্তাব গৃহীত হয়। উল্লেখ্য, মেকলে ছিলেন ‘কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকসনের সভাপতি। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে এই কমিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি মেকলে যে-প্রস্তাব পেশ করেন তা ‘মেকলে মিনিটস’ নামে পরিচিত। প্রস্তাবে বলা হয়, ভারতে ইংরেজিশিক্ষার বিস্তার ঘটলে ‘চুইয়ে পড়া নীতি' (Downward Filtration
Theory) অনুসারে সমস্ত জনগণের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়বে।
মেকলের প্রস্তাবমতো লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সিদ্ধান্ত নেন যে, সরকার ইংরেজি শিক্ষার জন্য অর্থ ব্যয় করবে।১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে সরকারি কাজকর্মে ইংরেজি ভাষা প্রচলিত হয়। ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে লর্ড হার্ডিঞ্জ ঘোষণা করেন, ইংরেজি শিক্ষিত ব্যক্তিদের সরকারি কাজে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
চার্লস উডের ডেসপ্যাসঃ-
স্যার চার্লস উড ছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি। তিনি ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক পরিবর্তনের জন্য একটি নির্দেশনামা পেশ করেন, যা উডের প্রতিবেদন’ বা ডেসপ্যাচ নামে পরিচিত। তিনি তার প্রতিবেদনে বলেন যে,
কলকাতা,বোম্বাই ও মাদ্রাজে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা।
শিক্ষা প্রসারের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষা বিভাগ গঠন করা ।
সরকারি মডেল স্কুল গুলির সংখ্যা বৃদ্ধি করা।
উডের নির্দেশ অনুসারে 1855 খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা দপ্তর স্থাপন করা হয়। 1857 খ্রিস্টাব্দের কলকাতা, মাদ্রাজ ও মুম্বাই-এ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়।
হান্টার কমিশনঃ- ইংরেজি শিক্ষা সম্পর্কে তথ্য ও সুপারিশের জন্য ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম হান্টার নেতৃত্বে হান্টার কমিশন নিযুক্ত হয় এই কমিশনের সুপারিশ গুলি হল প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি প্রতিটি বিদ্যালয়ে পাঠাগার স্থাপন মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি দান ইত্যাদি করা হবে।
পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন সরকারি নীতি হিসেবে গৃহীত হলে এই শিক্ষার দ্রুত বিস্তার ঘটে। কিন্তু এই শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি এবং ব্যয়বহুল হওয়ায় গরিব মানুষেরা এই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেনি এবং মুসলিমরাও এই শিক্ষা বর্জন করে। ফলে সমাজে নিরক্ষরতা বজায় থাকে । তা সত্ত্বেও বলা যায় পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার ফলে ভারতবাসীর মধ্যে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মধ্যযুগীয় ধারণার পরিবর্তন ঘটে এবং যুক্তিবাদী ধ্যান-ধারণার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে যা পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরিনতি লাভ করেছিল।
7.সমাজ সংস্কারে রাজা রামমোহন রায় ও বিদ্যাসাগর ভূমিকা আলোচনা কর?
ভূমিকা : উত্তর উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে যে-সমস্ত জ্যোতিষ্ক চিরস্মরণীয় অবদান রেখেগেছেন, তাঁদের মধ্যে একজন বাস্তববাদী ও মানবতাবাদী সংস্কারক ছিলেন ‘ভারত পথিক’ রাজা রামমোহন রায়। রাজা রামমোহন রায় সমাজের কুসংস্কার দূর করে আধুনিক সমাজ গঠনে প্রথম সচেষ্ট হয়েছিলেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন যে, রামমোহন রায় ছিলেন সমকালীন বিশ্বের সেই ব্যক্তি যিনি আধুনিক যুগের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন।
সমাজ সংস্কার:
ক) সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন : সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের সবচেয়ে বড়ো অবদান সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন। তৎকালীন হিন্দুসমাজের উচ্চবর্ণে অমানবিক সতীদাহপ্রথা প্রচলিত ছিল। এই প্রথা অনুসারে মৃত স্বামীর চিতায় তার জীবিত স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা হত। ধর্মশাস্ত্র ব্যাখ্যা-সহ বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে রামমোহন এই পৈশাচিক প্রথা বন্ধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তিনি এই প্রথার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন করেন। তার এই প্রচেষ্টার ফলে শেষপর্যন্ত গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ১৭নং রেগুলেশন জারি করে সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ বলে ঘোষনা করেন।
খ) নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা : রাজা রামমোহন রায় নারীদের অধিকার ও দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর যাতে তার বিধবা স্ত্রী স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে পারে তার জন্য তিনি স্বামীর সম্পত্তির উপর স্ত্রীর অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়েও আন্দোলন করেন কারণ তখন পিতা বা স্বামীর সম্পত্তিতে নারীদের কোনো অধিকার ছিল না।
গ) বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন : রামমোহন বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধেও আন্দোলন করেছিলেন। তিনি ভারতীয় শাস্ত্রের ব্যাখ্যা করে তা দেখিয়েছিলেন যে, প্রাচীন শাস্ত্রে পুরুষের বহুবিবাহের যথেচ্ছ অধিকার দেওয়া হয়নি। তবে প্রাচীনকালে কোন স্ত্রী ব্যাভিচারিণী, সুরাসক্ত ও বন্ধ্যা হলে পুরুষ পুনরায় বিবাহ করতে পারত।
ঘ)কৌলীন্য প্রথা ও বাল্যবিবাহের বিরোধিতা: রামমোহন কৌলীন্য প্রথাবিরোধী ছিলেন। কারণ এই কৌলীন্য প্রথার জন্যই সমাজচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় অল্পবয়স্ক মেয়েদের মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হত।
এছাড়াও রামমোহন রায় ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রাত্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন, তা ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ব্রাত্মসমাজ নামে খ্যাতি লাভ করে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল পৌত্তলিকতা পরিহার করে নিরাকার পরমব্রহ্মের উপাসনা করা।তিনি এখানেই থেমে যাননি;শিক্ষা-সংস্কৃতির জগতেও রামমোহন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষাবিস্তার ও গণতান্ত্রিক চেতনা প্রসারের চেষ্টা।
মূল্যায়ন: এভাবে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের উপর যুক্তির প্রাধান্য— যা নবজাগরণের মূল কথা, তা রামমোহনের কার্যকলাপে লক্ষ করা যায়। তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্য তাকে ‘ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ’ বলা হয়।
বিদ্যাসাগর
উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে যে-সমস্ত জ্যোতিষ্ক চিরস্মরণীয় অবদান রেখেগেছেন, তাঁদের মধ্যে আরও একজন হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তৎকালীন বাংলার জরাগ্রস্ত ও স্থবির সমাজ ব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাত করতে তিনি আমরণ লড়াই করেন।এই প্রসঙ্গে তাঁর নারী মুক্তি আন্দোলন প্রণিধানযোগ্য। এই জন্যই নারী মুক্তি আন্দোলনে তিনি ছিলেন ভারতের অন্যতম পথিকৃৎ।
বিদ্যাসাগর ও তাঁর সংস্কার আন্দোলন
বিধবা বিবাহ: সে যুগে হিন্দুসমাজে বাল্যবিবাহের চল ছিল। হিন্দুশাস্ত্রেও এই প্রথা স্বীকৃত ছিল। অনেক সময় বিবাহিতা বালিকারা অল্পবয়সেই বিধবা হত। তাদের দুঃখ-দুর্দশারও শেষ ছিল না। এজন্য তিনি বিধবাবিবাহ প্রথা আইন করে বলবৎ করার জন্য লড়াই করেন এবং সাফল্যও পান। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে সরকার ১৫ নং আইন দ্বারা বিধবা-বিবাহ আইন বিধি বদ্ধ করে। তিনি নিজের পুত্র নারায়ণের সঙ্গে ভবসুন্দরী নামক এক অষ্টাদশী বিধবার প্রথম বিবাহ দেন ৷১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের | মধ্যে তিনি এরূপ ৬০টি বিবাহ দেন।
বাল্যবিবাহ: বাল্যবিবাহ নামক সামাজিক ব্যাধি নির্মূল করার জন্য তিনি নিরলস সংগ্রাম করেন এবং সফলও হন। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে সরকার একটি আইন পাস করে মেয়েদের বিবাহের বয়স কমপক্ষে ১০ বছর ধার্য করে।
বহুবিবাহ: সেই যুগে হিন্দুসমাজে পুরুষের বহুবিবাহ করার অধিকার ছিল। সমাজে এই প্রথার বহুল প্রচলন ছিল। এই প্রথা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে তিনি সরকারি সাহায্য প্রার্থনা করেন। যদিও এবিষয়ে সরকার ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেনি।
অন্যান্য প্রথা: এ ছাড়া বিদ্যাসাগর মহাশয় সেযুগের কৌলিন্যপ্রথা, গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন প্রথা, জাতিভেদ প্রথা ও কুষ্ঠরোগীকে হত্যা করার প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তাঁর উদ্যোগেই খ্যাতনামা চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকার ‘বৈদ্যনাথ রাজকুমারী কুষ্ঠাশ্রম প্রতিষ্ঠিত করেন।
মূল্যায়ন: এই সমস্ত কারণে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই নির্ভীক সমাজসংস্কারক সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, এই ভীরুর দেশে তিনিই একমাত্র পুরুষ সিংহ। কবি মধুসূদন দত্ত তার নিঃস্বার্থ ব্রত ও হৃদয়বত্তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।