লােককথা কাকে বলে ? লােককথার বৈশিষ্ট্যগুলি
লেখাে
|
লােককথা কাকে বলে ? লােককথার বৈশিষ্ট্যগুলি লেখাে |
লােককথা
সংজ্ঞা : ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে লােককথার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন—
(i) টমলিনস ও লিব্রাউনের সংজ্ঞা : কার্ল টমলিনস ও ক্যারেল লিব্রাউনের মতে— মানুষের জীবন ও কল্পনার সংমিশ্রণে যেসব গল্পকথা গড়ে উঠেছে, তাকে লােককথা বলা হয়। এই গল্পকথাগুলি সুপ্রাচীন যুগ থেকে বর্তমান যুগে বংশপরম্পরায় প্রচলিত আছে। লােককথাগুলি সভ্যতার ঐতিহ্যবাহী সাহিত্য যা প্রাকৃতিক ও আধ্যাত্মিক জগতকে বােঝার ও ব্যাখ্যার চেষ্টা করে।
(ii) প্রাকৃতিক আইনের কার্যকারী নয় : যে কাল্পনিক গল্পকথা শ্রোতাদের এমন এক কাল্পনিক জগতে নিয়ে যায় যেখানে প্রাকৃতিক নিয়ম কার্যকারী হয় না, সেই কাল্পনিক গল্পগাথাকে লােককথা বলা হয়।
জনশ্রুতির যে কাহিনিগুলি একধরনের কাল্পনিক গল্পগাথা ও এমন একপ্রকারের ঐতিহ্যবাহী লৌকিক সাহিত্য যার সাহায্যে প্রাকৃতিক অথবা আধ্যাত্মিক কোনাে ঘটনার ব্যাখ্যা বা উপলদ্ধির চেষ্টা করা হয়, তাকেই বলে লােককথা। ]
উদাহরণ : বিষ্ণুশর্মার ‘পঞতন্ত্র’, নারায়ণ পণ্ডিতের ‘হিতােপদেশ’, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘আরব্য রজনী’ লােককথার উজ্জ্বল উদাহরণ। ডেনমার্কের হান্স ক্রিশ্চিয়ন অ্যান্ডারসন ও জার্মানির জ্যাকব ও উইলহেম গ্রিম ভ্রাতৃদ্বয় লােককথার জনপ্রিয় গল্পকার।
উদ্ভব :লােককথার উদ্ভবের সঠিক সময়কাল ঐতিহাসিকরা নির্ধারণ করতে পারেননি। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক অনুমান করেন সভ্যতার আদিযুগেই বিভিন্ন দেশে লােককথার জন্ম হয় বিভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতির মৌখিক ঐতিহ্য থেকে। লােককথার বৈশিষ্ট্য : লােককথার উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
(i) কাল্পনিক বিষয় : লােককথার কাহিনিগুলিতে মানুষের সঙ্গে বিভিন্ন কাল্পনিক ও ভৌতিক চরিত্র থাকে। যেমন— দৈত্য, দানব, পরি, ড্রাগন, ডাইনি প্রভৃতি। এ ছাড়াও বিভিন্ন পশুপাখিরও উল্লেখ থাকে।
(ii) নির্দিষ্ট স্থান-কাল-পাত্ৰ-এর অভাব : লােককথার কাহিনিতে কোনাে নির্দিষ্ট স্থান-কাল ও পাত্রের উল্লেখ থাকে । লােককথার গল্পগুলি শুরু হয় অনেকদিন আগে—এক দেশে এক রাজা থাকত এরকম অনির্দিষ্ট স্থান-কাল-পাত্র দিয়ে।
(iii) নিম্নশ্রেণির প্রাণীকে মানুষে পরিণত করা : লােককথার কাহিনিগুলিতে পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, সাপ, মাছ, কুমির প্রভৃতি নিম্নশ্রেণির প্রাণীগুলিকে মানুষের চরিত্রে পরিণত করা হয়। তারা মানুষের মতাে আচরণ করে, কথা বলে, চিন্তা করতে পারে।
(iv) মানুষের ওপর গুরুত্ব আরােপ : লােককথার কাহিনিগুলিতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ ঘটনাগুলির ওপরই বেশি গুরুত্ব আরােপ করে। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সুখ ও দুঃখের ঘটনাই গুরুত্ব পায়।
(v) সৃষ্টিকর্তার নাম না থাকা : লােককথার কাহিনিগুলিতে সৃষ্টিকর্তার রচয়িতার কোনাে নাম থাকে না। তাই রচয়িতা বা সৃষ্টিকর্তাদের সম্পর্কে কিছু জানা যায় না।
(vi) শিশুদের মনােরঞ্জন করা : লােককথার কাহিনিগুলিতে কেবলমাত্র শিশু ও কিশােরদের মনােরঞ্জনের রসদ থাকে, কারণ ধর্মীয় বিষয়ের ওপর গুরুত্ব না থাকায় বয়স্ক মানুষদের লােকক প্রতি কোনাে আগ্রহ থাকে না।
(vii) অলিখিত কাহিনি : লােককথার কাহিনিগুলি প্রথম অবস্থাতে । মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। বর্তমানযুগে বিভিন্ন দেশের লােককথার কাহিনিগুলিকে সংগ্রহ করে সংকলিত করে বই-এর আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।
(viii) বিশ্বজুড়ে প্রসার : লােককথার কাহিনিগুলি চারণ কবি, যােদ্ধা, ক্রীতদাস, নাবিক, সন্ন্যাসী, বিবাহিত নারীর মাধ্যমে একটি সমাজ ও দেশ থেকে অন্য দেশে ও সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে লােককথার কাহিনিগুলি বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।