বিভিন্ন দেশের
পৌরাণিক কাহিনির বিবরণ দাও। ইতিহাস রচনায় পৌরাণিক কাহিনিগুলির গুরুত্ব লেখো।
বিভিন্ন
দেশের পৌরাণিক কাহিনিঃ-
পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে জনপ্রিয় পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত আছে।বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের
অসংখ্য পৌরাণিক কাহিনিগুলি কখনোই ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি।পৌরাণিক কাহিনিগুলির
প্রতি মানুষের আকর্ষণের ফলে এক জনগোষ্ঠীর পৌরাণিক কাহিনি অন্য জনগোষ্ঠীতে জনপ্রিয়তা
লাভ করে।
1.
গ্রিক পুরাণঃ- গ্রিক পুরাণগুলি থেকে প্রাচীনযুগে গ্রিকদের
সমাজ, সংস্কৃতি, প্রথা ও রীতিনীতি জানা যায়।গ্রিক পৌরাণিক কাহিনিগুলির মধ্যে অন্যতম
হল ক্রেনাস ও তাঁর পুত্র দেবরাজ জিউসের কাহিনি।গ্রিক পুরাণ অনুসারে ক্রেনাস তাঁর পিতাকে
খোঁজ করে স্বর্গের দেবতাদের রাজা হন এবং তার বোন রেহয়াকে বিবাহ করেন।পিতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার
পর ক্রেনাসের মনে ভয় হয় যে তার পুত্রও তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে।তাই তাঁর
স্ত্রী রেহয়া কোনো সন্তানের জন্ম দেওয়ার দিনে প্রতিটি সন্তানকে ক্রেনাস ভক্ষণ করাতেন।এরপর
জিউসের জন্ম দেওয়ার পর রেহয়া তাকে লুকিয়ে রাখেন এবং ক্রেনাসকে নবজাতকের কথায় পাথর
মুড়ে দেন। ক্রেনাস পাথরটিকেই ভক্ষণ করে ফেলে তৃপ্ত হন। পরবর্তীকালে জিউস বড়ো হয়ে
তাঁর বাবাকে একটি ঔষধ খাওয়ালে তার বাবা সব ভাইকে উগরে দেন।এরপর জিউস ক্রেনাসকে যুদ্ধে
পরাজিত করে দেবতাদের রাজা হন।
2.
হিন্দু পুরাণঃ- প্রাচীন হিন্দু পুরাণের একটি জনপ্রিয়
কাহিনি হল—মহাকবি কালিদাসের কাহিনি।মহাকবি কালিদাস প্রথম জীবনে খুবই মূখ ছিলেন।পুরাণ
অনুসারে তিনি যে গাছের ডালে বসেছিলেন সেই ডালটির গোড়া কাটছিলেন।পরবর্তীকালে দেবী সরস্বতীর
বরে তিনি মহাকবি হন এবং সংস্কৃত ভাষায় ‘মেঘদূত’, ‘কুমারসম্ভব’-এর মতো অমূল্য মহাকাব্যগুলি
রচনা করেন।
3.
রোমের পৌরাণিক কাহিনিঃ- রোমের পৌরাণিক কাহিনিগুলির মধ্যে অন্যতম
হল রোমুলাসের কাহিনি।রোমাস ও রোমুলাস—দু-ভাইয়ের জন্মের পর তাদের মাতামহ তাদের একটি
তামার পাত্রে টাইবার নদীর জলে ভাসিয়ে দেন।একটি বাঘিনী তাদের নদী থেকে কুড়িয়ে নিয়ে
এসে মাতৃস্নেহ দিয়ে বড়ো করে তোলে।এরপর বড়ো হয়ে দুই ভাই তাদের মাতামহকে পরাজিত করে
ও একটি রাজ্য স্থাপন করে।পরবর্তীকালে রোমাসকে হারিয়ে রোমুলাস রাজা হন এবং রোমান সাম্রাজ্য
ও রোম নগরী প্রতিষ্ঠা করেন।রোমুলাসের নাম অনুসারেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজধানীর নাম হয়
রোম।
4.
বাইবেলের পৌরাণিক কাহিনিঃ- খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের উল্লেখযোগ্য
পৌরাণিক কাহিনি হল ‘নোয়া নৌকার কাহিনি।এই পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে প্রবল বন্যায় পৃথিবীর
সমস্ত স্থলভাগ ডুবে গেলে বিভিন্ন প্রাণীর একজোড়া করে প্রতিনিধি নোয়া নৌকাতে আশ্রয়
গ্রহণ করে।এই প্রাণীদের থেকেই পরবর্তীকালে পৃথিবীতে সমস্ত জীবজগতের বিস্তার ঘটে।
ইতিহাস
রচনায় পৌরাণিক কাহিনির গুরুত্বঃ-
পৌরাণিক কাহিনিগুলিতে কল্পনা এবং উপমার আধিক্যের জন্য অনেকে ঐতিহাসিক পৌরাণিক কাহিনিগুলিকে
অবাস্তব ও ভিত্তিহীন বলে মনে করেন।তবু মানবসভ্যতা, সংস্কৃতি ও ধর্মের ইতিহাসে পৌরাণিক
কাহিনি বা মিথগুলির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
1.
বংশলতিকাঃ- পৌরাণিক কাহিনি থেকে বিভিন্ন রাজবংশের নাম,
বংশ তালিকা ও পরিচয় জানতে পারা যায়। যেমন— হিন্দু পুরাণগুলি থেকে ভারতের বিভিন্ন
রাজবংশের|নাম, বংশ পরিচয় পাওয়া যায়।ড. রণবীর চক্রবর্তী বলেছেন, “পুরাণে বর্ণিত রাজবংশগুলির
অস্তিত্ব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বীকৃত সত্য”।
2.
সময়কাল নির্ণয়ঃ- পৌরাণিক কাহিনিগুলির সঙ্গে তুলনামূলক পদ্ধতিতে
যাচাই করে ইতিহাসের বহু সন-তারিখ নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছে।
3.
রাজ্যের নাম ও অবস্থানঃ- পৌরাণিক কাহিনিগুলি থেকে আমরা বহু প্রাচীন
রাজ্যের নাম ও তার ভৌগোলিক অবস্থানের কথা জানতে পারি।
4.
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনঃ- পৌরাণিক কাহিনিগুলি থেকে আমরা প্রাচীনযুগে
মানুষের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের কথা জানতে পারি।বর্তমানে প্রচলিত ধর্ম ও সংস্কৃতি
ওই প্রাচীন সংস্কৃতি থেকেই উৎপন্ন হয়েছে। পৌরাণিক কাহিনির সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে
প্রচলিত কাহিনিগুলি সত্য।
5.
সত্য উপাদানঃ- কল্পনা বা উপমার আধিক্য থাকলেও পৌরাণিক
কাহিনিগুলিতে বহু সত্য ও যথার্থ উপাদান লুকিয়ে থাকে। যেমন— গ্রিসের পৌরাণিক কাহিনিগুলি
থেকে ট্রয় নগরী ও ট্রয়ের যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। এই কারণে
বিয়ারলেইন পৌরাণিক কাহিনিগুলিকে গল্পের আকারে সত্য ঘটনার প্রকাশ বলেছেন।
মূল্যায়নঃ-
এক কথায় বলা যেতে পারে
যে—পৌরাণিক কাহিনি হল প্রাগৈতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার অন্যতম উপাদান। ধর্ম, দেশ ও
কালের পার্থক্য থাকলেও পৌরাণিক কাহিনিগুলির মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত বিশ্বজনীনতা আছে।
আধুনিক বিজ্ঞান নির্ভর সমাজেও এর গভীর প্রভাব আছে।
পোস্ট টি পড়ার জন্য ধন্যবাদ ভাল লেগে থাকলে অবশ্যই অন্যদের শেয়ার কর