রেনেসাঁস বলতে কী বোঝো?|নবজাগরণ বলতে কী বোঝো?|রেনেসাঁসের প্রধান বৈশিষ্ট্য কি ছিল? |ইউরোপীয় নবজাগরনের বৈশিষ্ট্য

dream
0

রেনেসাঁস বলতে কী বোঝো?|নবজাগরণ বলতে কী বোঝো?|

রেনেসাঁসের প্রধান বৈশিষ্ট্য কি ছিল?|ইউরোপীয় নবজাগরনের বৈশিষ্ট্য


রেনেসাঁস বলতে কী বোঝো?



রেনেসাঁস বা নবজাগরণের অর্থ (Meaning of Renaissan -ce)

মধ্যযুগে মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের কোনও সুযােগ ছিল না। মানুষের চিন্তা ও মানসিক বৃত্তি সম্পূর্ণভাবে গির্জার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত।সেদিন মানুষের স্বাধীনভাবে চিন্তা করা বা মতপ্রকাশের কোনও স্বাধীনতা ছিল না। গির্জা পােপ ও ধর্মযাজকদের আদেশই ছিল শিরােধার্য। মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা জীবনধারা শিল্প- সাহিত্য সবই সেদিন গির্জা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হত। দীর্ঘদিনের জড়তার পর কালক্রমে এক বলিষ্ঠ ও স্বাধীন চিন্তাধারায় মানুষের অবলুপ্ত ব্যক্তিত্ব পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠল। এই পুনরুজ্জীবিত ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীন চিন্তাশক্তির বিকাশ রেনাসাস বা নবজাগরণ নামে পরিচিত। রেনাসাস কথাটির বুৎপত্তিগত অর্থ হল পুনর্জন্ম। নবজাগরণ বলতে সাধারণভাবে প্রাচীন গ্রিক ও রােমান সাহিত্য দর্শন শিল্পকলা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানবার অদম্য উৎসাহকে বােঝায় কিন্তু ব্যাপক অর্থে রেনাসাঁস হল ব্যক্তিত্বের পুনর্জন্ম এক নতুন স্বাধীন সাহসিকতা পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তিবাদী চেতনা ও অনুসন্ধিৎসার বিকাশ।

ইউরোপীয় নবজাগরনের বৈশিষ্ট্য|

নবজাগরণের স্বৈশিষ্ট্য বা স্বরূপ ( Features or Nature of Renaissance):

রেনেসাঁস হল দীর্ঘ বিবর্তনের ফলশ্রুতি

দীর্ঘ বিবর্তনের ফলশ্রুতি:- নবজাগরণ কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়। দীর্ঘ বিবর্তনের ফলে পঞ্চদশ ও ষােড়শ শতকে নবজাগরণ নিজ রূপ পরিগ্রহ করে। প্রাচীনকালে গ্রিস ও রােমকে কেন্দ্র করে ভূমধ্যসাগর - অঞ্চলে এক বিরাট সভ্যতা গড়ে ওঠে। পঞ্চম শতকে বর্বর জার্মান উপজাতির আক্রমণে রােমান সাম্রাজ্যের পতন হলে এই সভ্যতাও বিলুপ্ত হয়। কেবলমাত্র পূর্ব রােম সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনােপলে কিছু পণ্ডিত নিজেদের মধ্যে গ্রিক ও রােমান সাহিত্য, সংস্কৃতি দর্শন ও বিজ্ঞানচর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন। 


ইউরােপের সাধারণ মানুষ তখন সক্রেটিস প্লেটো অ্যারিস্টটল ভার্জিল লিভি প্রমুখ মনীষীদের কথা ভুলেই গিয়েছিল। এই অবস্থায় ক্রুসেডের পরবর্তীকালে আরবীয় সভ্যতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ বাণিজ্যের প্রসার শহরের বিকাশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্তন ইউরােপের মানুষের চিন্তাধারাকে নতুন পথে প্রবাহিত করে। দ্বাদশ ও ত্রয়ােদশ শতাব্দীতে গ্রিক ও আরবীয় দর্শনে পারদর্শী কৃতী পণ্ডিতগণ প্রচলিত বিশ্বাসকে অন্ধভাবে না মেনে একটি যুক্তিগ্রাহ্য মনােভাব গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। আর কুসংস্কার বা অন্ধবিশ্বাস নয়—মানুষ সব কিছুর পিছনে যুক্তির অনুসন্ধান করতে থাকে। যুক্তির দ্বারা যা সমর্থিত নয় মানুষ তা বর্জন করে। 


দ্বাদশ শতক থেকে ইউরােপের নানা স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এইসব বিশ্ব বিদ্যালয়ে বাইবেল এবং পােপ ও অন্যান্য সন্ন্যাসীদের ধর্মসংক্রান্ত রচনাবলী অ্যারিস্ট -টলের তর্কশাস্ত্র ও দর্শন আরবীয় চিকিৎসাশাস্ত্র গণিত জাস্টিনিয়ানের আইনগ্রন্থ প্রভৃতি পড়ানাে হলেও এই শিক্ষাধারা তরুণ মনে নবচেতনার সঞ্চার করে। এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু কৃতী ও উল্লেখযােগ্য শিক্ষক ছিলেন। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিটার এবেলার্ড (১০৭৯-১১৪২ খ্রিঃ) ছিলেন প্রবল যুক্তিবাদী । যুক্তির আলােকে বিচার না করে তিনি কোনও কিছুই গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না।


১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনােপলের পতনের পূর্ব থেকেই গ্রিক ও রােমান সাহিত্যে সুপণ্ডিত ব্যক্তিগণ ইউরােপের নানা দেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে শুরু করেন। এর ফলে প্রাচীন গ্রিক ও রােমান সাহিত্য ও সংস্কৃতি জনমনে প্রবল আগ্রহের সঞ্চার করে। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টি নােপলের পতন হলে সেখানকার গ্রিক পণ্ডিতেরা তাদের জ্ঞানভাণ্ডার নিয়ে ইতালি ও ইউরােপের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েন। এর ফলে ইতালি ও ইউরােপে প্রাচীন গ্রিক ও রােমান সংস্কৃতি সম্পর্কে অনুরাগ বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।


রেনেসাঁস ও যুক্তিবাদ (Renaissance and Rationalism)

যুক্তিবাদ:- মধ্যযুগে সব কিছুই ছিল ধর্মনির্ভর। গির্জা, পােপ ও ধর্মযাজকরাই ছিলেন মানব-জীবন, সমাজ ও সভ্যতার মূল নিয়ন্তা। তাদের আদেশ ছিল অভ্রান্ত ও অপরিবর্তনীয়। এর বিরুদ্ধে কোনও প্রশ্ন তােলা যেত না। গির্জা- বিরােধী যে কোনও বক্তব্য বা আচরণ ছিল ধর্মবিরােধী এবং ক্ষমার অযােগ্য। 


এ যুগের মূল কথাই ছিল সব কিছু মেনে নাও কিছু জানতে চেয় না। ক্রমে এই অন্ধবিশ্বাস ও আনুগত্যের স্থলে এলাে যুক্তিবাদ। এই যুক্তিবাদই হল নবজাগরণের মূল বক্তব্য । যুক্তিহীন বা পরীক্ষিত সত্য নয় এমন কোনও কিছুই মানুষ আর গ্রহণ করতে রাজি হল না। দ্বাদশ শতক থেকে পণ্ডিতরা গির্জার নির্দেশকে অভ্রান্ত বলে না মেনে যুক্তির কাছে আশ্রয় গ্রহণের দিতে থাকেন।


রেনেসাঁস ও প্রাচীন শিক্ষা-সংস্কৃতির পুনরুদ্ধার

প্রাচীন শিক্ষা-সংস্কৃতির পুনরুদ্ধার: মধ্যযুগে গ্রিক ও রােমান সাহিত্য ও দর্শন অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। যুক্তিবাদের স্থলে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার সমগ্র ইউরােপকে ছেয়ে ফেলে। গির্জার প্রভাবে মানুষ ইহ -লােক অপেক্ষা পরলােকের চিন্তায় ভীত হয়ে ওঠে। পঞ্চদশ শতকে অবলুপ্ত গ্রিক ও রােমান সাহিত্য ও দর্শনের প্রতি প্রবল আগ্রহই নবজাগরণের যে, প্রাচীন গ্রিস ও রােমের মানুষ সূচনা করে। 


মানুষ বুঝতে পারে স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করত। তারা যুক্তির দ্বারা সব কিছু বিচার করত। মধ্যযুগে প্রাকৃতিক জগৎ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্পর্কে কিছু চিন্তা করা ধর্মবিরুদ্ধ ছিল। নবজাগরণ প্রাকৃতিক জগৎ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৈজ্ঞানিক সত্য সম্পর্কে মানুষকে শ্রদ্ধাশীল করে তােলে।


রেনেসাঁস ও মানবতাবাদ|Renaissance and Humanism|নবজাগরণও মানবতাবাদ|

রেনেসাঁস ও মানবতাবাদের সপর্ক


নতুন জীবনদর্শন:- নবজাগরণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মানবতাবাদ (Humanism)। এখানে মানুষই প্রধান। মানুষ এবং জড় জগতই হল সব কিছুর কেন্দ্রে । এইভাবে নবজাগরণ মানুষের কাছে ব্যক্তি- স্বাধীনতা মানবতা -বাদ মানবমুক্তি ঐহিকতা ও যুক্তিবাদের বার্তা বহন করে আনে।


ফলে জীবন সম্পর্কে ধর্ম -নিরপেক্ষ পুরােনাে গ্রিক মূল্যবােধ পুনরুজ্জীবিত হয়। মানুষ তার মর্যাদা ফিরে পায়। গির্জা মানুষকে পরলাে -কে সুখভােগের স্বপ্ন দেখাত। নবজাগরণ কিন্তু মানুষ -কে ইহজগতে পার্থিব সুখভােগ ও আনন্দময় জীবন যাপনের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে। পরলােক নিয়ে মানুষ আর চিন্তিত নয়। নানা প্রাকৃতিক ঘটনা বা দুর্দৈবকে মানুষ আর দেবতার কাজ বলে মানতে রাজি নয়। এগুলির পিছনে যুক্তিসম্মত বৈজ্ঞানিক কারণের অনুসন্ধান শুরু হয়। 


রেনেসাঁস ও অনুসন্ধিৎসা

অনুসন্ধিৎসা:- নবজাগরণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল অনুসন্ধিৎসা। মানুষের মধ্যে অজানাকে জানার আগ্রহ দেখা দেয়। লুপ্তপ্রায় গ্রন্থাদি ও চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য মানুষের মধ্যে অদম্য আকাঙ্ক্ষা দেখা দেয়। এ থেকেই সাহিত্য দর্শন শিল্প বিজ্ঞান ও ইতিহাস সম্পর্কে নতুন জ্ঞানলাভের চেষ্টা শুরু হয়। গির্জার অনুশাসন অনাচার ও সামাজিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তােলা হয়। শুরু হয় ভৌগােলিক আবিষ্কা -রের প্রয়াস।

এইভাবে নবজাগরণ মানুষের জীবনচর্যার ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে।


FAQs

(ইউরোপের নবজাগরন বা রেনেসাঁস সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় প্রশ্ন)


1. কে সর্বপ্রথম রেনেসাঁস শব্দটি ব্যবহার করেন?

উ:- ঐতিহাসিক মিশেলে 1855 খ্রিষ্টাব্দের রেনেসাঁস শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন।


2. রেনেসাঁস কথাটির অর্থ কি ? 

উ:- পুনর্জন্ম বা পুনর্জাগরণ


3. বাংলার রেনেসাঁসের জনক কাকে বলা হয়?

উ:- রাজা রামমোহন রায়


4. রেনেসাঁস বা নবজাগরণ বলতে কি বোঝ?

উ:-নবজাগরণ বা রেনেসাঁস শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল পুনর্জন্ম কিন্তু এটি অত্যন্ত সংকীর্ণ, ব্যাপক অর্থে বলতে গেলে বলা যায় নবজাগরণ বা রেনেসাঁস বলতে বোঝায় পঞ্চদশ ও ষােড়শ শতকে ইউরোপ মহাদেশে বিশেষত ইতালিতে মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটিয়ে যে এক নতুন মানবতাবাদের সূত্রপাত ঘটেছিল তা হল নবজাগরণ


5. রেনেসাঁসের জনক বলা হয়?

উ:- রেনেসাঁর জনক ছিলেন বিখ্যাত শিল্পীদের একটি দল।  আর শিল্পীরা হলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ডোনাটে -লো বার্দি রাফায়েল সানজিও দা উরবিনো এবং মাইকেলেঞ্জেলো বুওনারোতি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top