ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণস্থান ও উচ্চারণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা (বাংলা ব্যাকরণ)
ব্যঞ্জনবর্ণের
উচ্চারণস্থান ও উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যঃ
প্রথমেই বগীয় বর্ণের
উচ্চারণস্থান ও তাদের উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যের আলােচনা করা যাক
ক- বর্গ: ক্, খ্, গ্, ঘ্, ঙ্ ক্,
খ্, গ্, ঘ্, ছ্
এদের উচ্চারণের সময়
জিভের গােড়ার দিকটা (জিহ্বামূল) কষ্টের দিকে তালুর নরম অংশ স্পর্শ করে; তাই এরা কণ্ঠ্যবর্ণ বা জিহ্বামূলীয় বর্ণ। অল্পপ্রাণ
এবং অঘােষধ্বনি। ক্- এর সঙ্গে ‘হ্’-ধ্বনি
যুক্ত হয়ে খ- এই মহাপ্রাণ ধ্বনির উদ্ভব। ‘খ্’-
মহাপ্রাণ, ঘােষধ্বনি। ‘গ্’- অল্পপ্রাণ
ঘােষধ্বনি। ‘ঘ্’- (গ্হ্) মহাপ্রাণ,
ঘােষধ্বনি। অনুনাসিক ঘােষধ্বনি। ‘ঙ্’- এর
উচ্চারণ উঁঅঁ। এই বর্ণটি কখনাে শব্দের আদিতে বসে না, এমন কি হসচিহ্নযুক্ত শুদ্ধ ব্যঞ্জনের
পরেও বসে না; সর্বদাই স্বরের পরে বসে। বর্ণটির দু’রকম উচ্চারণ লক্ষ্য করা যায়। যথা—
১. হস্ চিহ্নযুক্ত
‘’-র্ উচ্চারণ ং (অনুস্বার)-এর মতাে হয়। যেমন রং, বা রং, ঢ বা ঢং, স বা সং ইত্যাদি।
২. স্বরধ্বনি যুক্ত
‘ঙ’-র উচ্চারণে ‘গ’ ধ্বনির আগমন ঘটে। যেমন রঙিন (রঙ্গিন= ঙ+গ), বাঙালী (বাঙ্গালী),
লাঙল (লাঙ্গল) ইত্যাদি।
চ-বর্গ: চ্, জ্, ঝ্, ঞ্
চ্, ছ্, হ্, জ্, ঝ্, ঞ্ এদের উচ্চারণের সময় জিভের মাঝখানটা তালুর কঠিন অংশ স্পর্শ করে ; তাই এরা তালব্য বর্ণ। চ্, ছ্, জ্, ঝ্ এই তালব্য-স্পর্শবর্ণগুলির উচ্চারণের সময় শ্বাসবায়ুর নির্গমন বিশুদ্ধ খৃষ্টধ্বনি নয়। কারণ, এদের উচ্চারণে জিভের সঙ্গে তালুর সংযােগ পুরােপুরি ঘটে না, বরং উভয়ের মাঝখানের বাতাসের ঘর্ষণে খানিকটা উষ্মধ্বনির মতাে উচ্চারিত হয় ; তাই এরা ঘৃষ্টবর্ণ। চ্ অল্পপ্রাণ, অঘােষধ্বনি।,ছ্ মহাপ্রাণ, অঘােষধ্বনি।,জ্ অল্পপ্রাণ, ঘােষধ্বনি। ঝ মহাপ্রাণ, ঘােষধ্বনি। জ্ ও ঝ্ এর আসল উচ্চারণ ইংরেজি ‘z' ও ‘zh’-এর মতাে। এদের ঠিক ঠিক উচ্চারণ বাংলায় মেলে না,। এদের উচ্চারণ বর্তমানে ইংরেজি jও jh-এর মতাে। বর্গীয়-জ-এর উচ্চারণ অন্তঃস্থ-য-এর সঙ্গে এক হয়ে গেছে। জ্ -এর হসন্ত উচ্চারণেz-ধ্বনি পাওয়া যায়। যেমন মজদুর (মজু-দুর), সেজদা (সেজদা), বাজতে (বাজ-তে)। জল, জননী, ভাজা, রাজা এক্ষেত্রে জ্-এর উচ্চারণ ‘য্,(j)-এর মতাে। ঝ্ (jh) -সাঁঝ, মাঝ ইত্যাদি। ঞ্ অনুনাসিক, ঘােষবর্ণ; এর উচ্চারণ ইআঁ বা ইয়। এই বর্ণটি কখনাে শব্দের আদিতে বসে না। যেমন মিঞা বা মিয়া। তবে, ‘ঞ্’-এর সঙ্গে চ্, ছ্, জ্, ঝ্, যুক্ত হলে এর উচ্চারণ দন্ত্য-ন-এর মতাে হয়। যেমন পঞ্চম (প চম), বাঞ্ছা (বাছা), রঞ্জন (রজ্জ), ঝঞ্জা (ঝঝা) ইত্যাদি।
ট-বর্গ: ট্, ঠ্, ড্, ঢ্, ণ্
ট্, ঠ্, ড্, ঢ্,
ণ্ – এদের উচ্চারণের সময় জিভের আগাটা উলটিয়ে তালুর পেছন দিকের অংশ অর্থাৎ মুধাকে
স্পর্শ করতে হয় ; তাই এরা মূর্ধন্য বর্ণ।,ট্- অল্পপ্রাণ, অঘােষধ্বনি। ঠ্ মহাপ্রাণ, অঘােষধ্বনি। ড্ অল্পপ্রাণ, ঘােষধ্বনি। ঢ্ - মহাপ্রাণ, ঘােষধ্বনি। ণ্ অনুনাসিক,
ঘােষধ্বনি। তৎসম শব্দে, ণত্ববিধান অনুসারে লেখায় মূর্ধন্য-ণ্ ব্যবহৃত হয়, কিন্তু
উচ্চারণে ‘ণ্ ত্-বর্গের পঞ্চম বর্ণ দন্ত্য-ন
(নাসিক্য বর্ণ)-এর মতােই উচারিত হয়। তৎসম শব্দের বানানে ণ্ ও ন্-এর পার্থক্য থাকলেও
বাংলা উচ্চারণে এদের কোন পার্থক্য নেই। তবে, ‘ট্, ঠ্, ড্, ঢ্’-এর পূর্বে মূর্ধন্য-ণ্-এর
সঠিক উচ্চারণ কিছুটা শােনা যায়। যেমন কণ্টক, কণ্ঠ, ষণ্ড ইত্যাদি।,
ড্, ঢ়্: ড ও ঢ-এর তলায় বিন্দু দিয়ে ড় ও ঢু লেখা হয়। এ-দুটি বাংলার নিজস্ব বর্ণ। জিভের আগাটা উলটিয়ে, তার তলার দিক দিয়ে মুধায় আঘাত (তাড়ন) করলে এই বর্ণদুটির উচ্চারণ হয়; তাই এদের তাড়নজাত ধ্বনি বলে। ড় - অল্পপ্রাণ, ঘােষধ্বনি এবং ঢ় মহাপ্রাণ, ঘােষধ্বনি। যথা- ষড়যন্ত্র, কড়া, দাড়া, বড়, বাড়ি, গাড়ি, দৃঢ়, মূঢ়, গূঢ় ইত্যাদি। অনেকে ডু-এর উচ্চারণ ‘র’-এর মতাে করে, ফলে শব্দের বানান ও অর্থের বিপর্যয় ঘটে। যেমন বাড়ি (ঘর) বারি (জল), বড় বর, চড় - চর, চুড়ি ঘােরা, হাড় হার, আমড়া আমরা ইত্যাদি। তাই, ড-এর উচ্চারণ বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত।
ত-বর্গ: ত্, থ্, দ্, ধ্, ন্
ত্, থ্, দ্, ধ্,
ন্- এদের উচ্চারণের সময় জিভের আগাটা দিয়ে উপর পাটির দাঁতের পিছন দিকে স্পর্শ করতে
হয়, তাই এরা দন্ত্যবর্ণ।
ত্- অল্পপ্রাণ, অঘােষধ্বনি। থ্ মহাপ্রাণ, অঘােষধ্বনি। দ্ অল্পপ্রাণ, ঘােষধ্বনি। ধ্— মহাপ্রাণ, ঘােষধ্বনি। ন্ - অনুনাসিক, ঘােষধ্বনি। বাংলায় দন্ত্য,ন্ ও মূর্ধন্য-ণ-এর উচ্চারণ একই রকম, কোন পার্থক্য নেই।
[মনে রাখবে : সংস্কৃত (তৎসম) শব্দ বাংলা (তদ্ভব) শব্দে রূপান্তরের সময় ত- -বর্গের বর্ণ (দন্ত্যবর্ণ) ট-বর্গের বর্ণে (মূর্ধন্য বর্ণ) পরিণত হয়, তাকে মূর্ধন্যীভবন বলে। যথা- পততি > পড়ে, (ত > ড়), বৃদ্ধ > বুড়াে (দ্ধ > ড়), স্থান > ঠাঁই (থ > ঠ)।]
প-বর্গ: প্, ফ্, ব্, ভ্, ম,
- প, ফ, ব, ভ, ম্ – এদের উচ্চারণের সময় জিভের উপরের ঠোঁটের (ওষ্ঠ) সঙ্গে নিচের ঠোঁটের (অধর) স্পর্শ ঘটে, তাই এরা ওষ্ঠ্যবর্ণ।
প্- অল্পপ্রাণ, অঘােষধ্বনি। ফ্ মহাপ্রাণ, অঘােষধ্বনি। ব্ অল্পপ্রাণ, ঘােষধ্বনি। ভ্ - মহাপ্রাণ, ঘােষধ্বনি। ম্ অনুনাসিক, ঘােষধ্বনি। শব্দের আদি ও মধ্যে অ-কার যুক্ত ম-এর উচ্চারণ কখনাে-কখনাে মাে-এর মতাে হয়। যেমন মতাে (মােতাে), মন্দ (মােন্দো), সমতা (সমােতা), মরসুম (মােরসুম), সমজদার (সমােজদার) ইত্যাদি। কিন্তু মরণ, মঠ, মহর্ষি, মলয়, মৎস্য ইত্যাদি বহু শব্দেই অ-কার যুক্ত ম-এর উচ্চারণ স্বাভাবিক। ম যখন ম-ফলা রূপে যুক্ত হয় তখন বাংলা উচ্চারণে শব্দের আদিতে ম-ধ্বনি অনুচ্চারিত থাকে এবং যে বর্ণের সঙ্গে যুক্ত ছিল সেটিতে একটু অনুনাসিক স্পর্শ লাগে। যেমন শ্মশান (শশা), শ্মশ্রু (শোঁস), স্মরণ (র) ইত্যাদি। শব্দের মধ্যে ও অন্তে ম-ফলার ম-ধ্বনি অনুচ্চারিত থাকে। যে বর্ণের সঙ্গে যুক্ত থাকে সেটির দ্বিত্ব হয় এবং একটু অনুনাসিক স্পর্শ লাগে। যেমনপদ্ম (পদদোঁ), বিস্মরণ ( বিরণ), বিস্ময় (বিস্ময়), লক্ষ্মী (লী), মহাত্মা (মহাত্তা), ভীষ্ম (ভীশশ) ইত্যাদি। তবে, নিচের উদাহরণগুলিতে ম-ফলার ম-ধ্বনি উচ্চারিত হয়। যেমন মৃন্ময় ( ম্রিয়), চিন্ময় (চিন্ময়), মন্ময় (ময়), তন্ময় (তন্ময়), হিরম্ময় (হিরণময়), বাল্মীকি (বামিকি), যুগ্ম (যুগম) ইত্যাদি।,
অন্তঃস্থ বর্ণ: য (য়), র, ল, ব
য, য়– বাংলায় অন্তঃস্থ- ‘য’-এর উচ্চারণ বগীয়-‘জ’-এর উচ্চারণের সঙ্গে মিলে গেছে। সংস্কৃতে (হিন্দীতেও) অন্তঃস্থ-য’-এর উচ্চারণ‘ই’ (ya)৷ এটি অর্ধ-স্বর।অন্তঃস্থ-“য়’-এর ঠিক ঠিক উচ্চারণ বােঝানাের জন্য বাংলায় ‘য’-এর নিচে বিন্দু দিয়ে নতুন বর্ণের উদ্ভব হয়েছে ‘য়’ (ইঅ); এটি অর্ধস্বর এবং উচ্চারণ স্থানানুসারে তালব্যবৰ্ণ। অন্তঃস্থ-য অধস্বর, কিন্তু বাংলায় শব্দের আদিতে ব্যবহৃত হলে, এর ব্যঞ্জন উচ্চারণ বগীয়-জ-এর সঙ্গে মিলে যায়। যেমন যাদব (জাদব), যদু (জোদু), যজ্ঞ (জজ্ঞাে), যদি (জোদি), যশোেদা (জশশাদা), যক্ষ (জখাে), যথা (জথা), অন্তেও যমালয় (জমালয়), যমুনা (জোমুনা) ইত্যাদি। কখনাে-কখনাে শব্দের মধ্যে অন্তেও অন্তঃস্থ-‘য’-এর উচ্চারণ ‘জ’-এর মতাে হয়। যেমন- সংযোজন(সংজোজন্),নিযুক্ত(নিজুক্ত), সরযূ(সরোজু),শয্যা(শোজ্জা)
‘অন্তঃস্থ-য’ যখন য-ফলা, তখন উচ্চারিত হয় না। কোনাে-কোনাে স্থানে ‘এ’ বা ‘অ্যা’ ধ্বনির মতাে শােনা যায়। যেমন ব্যক্তি (বেক্তি), ব্যথিত (বেথিত), ব্যতীত (বেতিততা), ব্যয় (ব্যায়), ব্যবহার (ব্যাবােহার), ব্যথা (ব্যাথা) ইত্যাদি। কোন-কোন স্থানে, য-ফলা লােপ পায়। যথা দূত (দূত), নন (ন), ব্যহ (বৃহ), ব্যুৎপত্তি (বুৎপত্তি) ইত্যাদি। কোন কোন স্থানে, য-ফলা যুক্ত বর্ণটি দ্বিত্ব হয়ে যায়। যথা – বিদ্যা (বিদ্দা), উদ্যান (উদ্দান), সত্যি (শােতি), অব্যয় (অয়) ইত্যাদি।
[মনে রাখবে: ড, ঢ, য, র— এই বর্ণগুলিতে য-ফলা যােগ করা যায় না।]
অন্তঃস্থ-য় অর্ধস্বর হিসাবে উচ্চারিত হয়। যেমন হয়, জয়, ভয়, সময়, নিয়ম, ময়ূর, নিয়ােগ, বিয়ােগ, তনয় ইত্যাদি। কোন কোন স্থানে ‘য়’ধ্বনিটি শােনা যায় না, শুধু তার সঙ্গে যুক্ত স্বরধ্বনিটি শােনা যায়। যেমন দেয়া (দেআ), যাওয়া (যাওআ), কেয়া (কেআ), শােয়া (শাআ), দেখিয়ে (দেখিএ) ইত্যাদি।
র- জিভের আগাটা কাঁপিয়ে, দাঁতের গােড়ায় আঘাত করে বর্ণটি ঘােষবৎ উচ্চারিত হয়। এজন্য দন্তমূলীয় এই বর্ণটিকে কম্পনজাতবর্ণ-ও বলা হয়।‘র’-ব্যঞ্জনবর্ণের পরে যুক্ত হলে র-ফলা )। যেমন য়, ঘ্রাণ, বক্র, নম্র, বিভ্রান্ত ইত্যাদি। ‘র’-ব্যঞ্জনবর্ণের আগে যুক্ত হলে রেফ (/)। যথা বর্ণ (বন), ঝর্না (ঝরনা),বর্বর (বরবর) ইত্যাদি। র-ফলার উচ্চারণ বেশ কঠিন, রেফের উচ্চারণ কিছুটা শিথিল।
ল- জিভের আগাটা দাঁতের গােড়ায় ঠেকিয়ে জিভের দু’পাশ দিয়ে বাতাস বের করে দিয়ে দন্তমূলীয় এই বর্ণটির ঘােষবৎ উচ্চারণ হয়। এজন্য একে পার্শ্বিক বর্ণ-ও বলে। ‘ল’ যখন ল-ফলা হিসাবে শব্দের মধ্যে বা অন্তে বসে তখন, যে ব্যঞ্জনটির সঙ্গে যুক্ত থাকে সেটি দ্বিত্ব হয়। যথা বিপ্লব (বি-প্লব), শুক্ল (শুক্কু), অম্ল (অমল্ল) ইত্যাদি।
ব– বাংলায় বর্গীয়-‘ব’ (b) ও অন্তঃস্থ-ব (উয়=w)-এর মধ্যে আকৃতিগত কোন পার্থক্য নেই এবং দু’টির উচ্চারণও একই রকম, অথাৎ ইংরেজি b-এর মতাে। খাঁটি অন্তঃস্থ-ব (উয়=w) অর্ধস্বর। উচ্চারণ স্থান ওষ্ঠ, তাই ওষ্ঠ্যবর্ণ। ব্যঞ্জনের সঙ্গে ব-ফলা রূপে যুক্ত ‘ব’-ই সাধারণত অন্তঃস্থ-‘ব’ (w)। এটি অনুচ্চারিত থাকে এবং অন্তঃস্থ-“ব’ যুক্ত ব্যঞ্জনটি দ্বিত্ব হয়ে উচ্চারিত হয়। যথা সত্বর (সত্তর), বিশ্ব (বিশ), বিশ্বাস (বিশশা)। শব্দের আদিতে ব-ফলা যুক্ত ব্যঞ্জনটির ক্ষেত্রেও উচ্চারণে দ্বিত্ব ভাবের আভাস পাওয়া যায়। যথা স্বপ্ন (স্-সনাে), স্বল্প (স্-সপাে), ধ্বনি (ধ-ধনি), দ্বার (দ-দার) ইত্যাদি। কিছু-কিছু তৎসম শব্দে অন্তঃস্থ-ব (w) -এর ‘উয়’ -ধ্বনির আভাস মেলে। যেমন জিহ্বা, আহ্বান, বিহুল, গহুর, বহ্বারম্ভ ইত্যাদি। [মনে রাখবে: অন্তঃস্থ-ব ও বগীয়-ব চেনার উপায় হল যে ‘ব’ ‘উ’-তে পরিণত হয়, জাত হয়, যে ‘ব’ কৃৎ ও তদ্ধিত-প্রত্যয়জাত অথবা সন্ধি-জাত হয় সাধারণত তা-ই অন্তঃস্থ-ব; বাদবাকি বগীয়-ব। যথা অন্তঃস্থ-ব>উ 'Vবচ+ক্ত উক্ত, Vবপ+ক্ত =উপ্ত (বােনা)। উ>অন্তঃস্থ-ব মনু+ষ্ণ=মানব, রাঘব, দানব। প্রত্যয়জাত অন্তঃস্থ-ব ভগবান্ মাতৃবৎ, ঈশ্বর, ভাস্বর, বিদ্বান,নশ্বর, যাযাবর, সংবাদ, সরস্বতী ইত্যাদি।]সন্ধি-জাত অন্তঃস্থ- ব— সু+অল্প = স্বল্প, স্বাগত, নাবিক, পবিত্র, মন্বন্তর, পবন, ভবন, ভাবুক ইত্যাদি।
উষ্মবর্ণ: শ্, ষ্, স্, হ্
তালব্য-শ্, মূর্ধন্য-ষ্, দন্ত্য-– তিনটি আলাদা বর্ণ হলেও বাংলায় এদের উচ্চারণ একই রকম ; অর্থাৎ শ-এর ধ্বনি—ইংরেজি sh -এর মতাে। শ-এর স্বাভাবিক উচ্চারণ (sh) আশমান, আকাশ, শৈশব, আশা, আশিস্ (আশি) ইত্যাদি। কিন্তু, ন-ফলা, র (ঋ-কার ও র-ফলা), -এর পূর্বে অবস্থিত তালব্য-শূ (sh) -এর উচ্চারণ দন্ত্য-স্ এর মতাে। যেমন: প্রশ্ন (প্রােস্নাে), শৃঙ্গ (সিঙ্গ), শৃগাল (ভ্রিগাল), শ্রম (শ্রোম), শ্রীমান (শ্রীমান), শ্লীল (স্লীল), শ্রবণ (স্রোবাে), শ্লাঘা (স্লাঘা), শ্রমিক (স্রমিক) ইত্যাদি।
মূর্ধন্য-ষ্ উচ্চারণ
বাংলায় শ (sh) -এর মতাে। যেমন- ভীষণ (ভিশােন), সৃষ্টি (সিটি), কৃষক (ক্ৰিশক), ভাষা
(ভাশা) ইত্যাদি। কিন্তু ষাঁড়’ শব্দের ‘’-এর উচ্চারণ মূর্ধন্য।
বাংলায় দন্ত্য-স্ (s)-এর নিজস্ব উচ্চারণ নেই। এটির উচ্চারণ তালব্য-শ (sh)-এর মতাে। যথা – সুকুমার (শুকুমার), সুখ (শুখ), কুসুম (কুশুম), সমীর (শমীর), সবল (শবল) ইত্যাদি। কিন্তু ঋ-কার, র-ফলা, ত, থ, ন, ও ল-যুক্ত স্-এর উচ্চারণ দন্ত্য (s) হয়। যেমন সৃষ্টি (স্রিশ্টি), সংস্রব (শংস্রোব), সস্তা (শস্তা), সুস্থ (শুস্থো), স্নান (স্নান), স্লেট ,(স্লেট্) ইত্যাদি।,
হ - ‘হ্’ এই উষ্মবর্ণটির উচ্চারণ স্থান কণ্ঠ। উচ্চারণে শাস বায়ুর প্রাধান্য থাকে, এটি মহাপ্রাণ বর্ণ এবং উচ্চারণ কালে গুরু গম্ভীর আওয়াজ (ঘােষ) নির্গত হয়, তাই ঘােষবর্ণ। বাংলায় হ্-এর হলন্ত উচ্চারণ কদাচিৎ হয়। য-ফলা যুক্ত হ-ছাড়া, সর্বত্রই হ-ধ্বনির স্বাভাবিক উচ্চারণ লক্ষ্য করা যায়। যেমন হয়, হাওয়া, হিসাব, হস্তী, স্নেহ, দেহ, হরিণ, ইত্যাদি। শব্দের আদিতে য-ফলা যুক্ত হ-এর উচ্চারণও স্বাভাবিক। যেমন হ্যাঁ, হ্যারিকেন, হ্যাংলা, হ্যাট, হ্যান্ডনােট ইত্যাদি। কিন্তু শব্দের আদিতে না হলে য-ফলা যুক্ত হ-এর উচ্চারণ জঝ-এর মতাে। যেমন-বাহ্য (বাজ্ঝো), সহ্য (শােজ্ঝাে), ঐতিহ্য (ঐতিজ্ঝাে), দাহ্য (দাজ্ঝাে), গ্রাহ্য (গ্রাজ্ঝাে) ইত্যাদি।
অযােগহবর্ণ; (অনুস্বার),
(বিসর্গ)
২ (অনুস্বার) : এই অযােগবাহ বা আশ্রয়স্থানভাগী চিহ্নটির (বর্ণ) উচ্চারণ স্থান নাসিকা। বাংলায় অনুস্বারের (ং) আর ‘’-এর উচ্চারণ একই রকম। এই জন্য একটির বদলে অন্যটির ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন রং- রঙ, বাংলা বাঙলা, সংগীত। সঙ্গীত (ঙ+গ = ঙ্গ) দু’রকমই লেখা চলে।
(বিসর্গ); এই অযােগবাহ
বা আশ্রয়স্থানভাগী বর্ণটি ‘হ’-এর অঘােষধ্বনির মতাে উচ্চারিত হয়। তাই এটি মহাপ্রাণ
অঘােষবর্ণ। বিসর্গের (ঃ) উচ্চারণস্থান কণ্ঠ, তাই কণ্ঠ্যবর্ণ। বাংলায় বিসর্গ (ঃ) চিহ্নের
ব্যবহার খুব কম। আঃ, উঃ, ওঃ, বাঃ ইত্যাদি বিস্ময়াদি সূচক অব্যয়ে দেখা যায় এবং এক্ষেত্রে
বিসর্গের উচ্চারণ ‘হ্’-এর মতাে।
শব্দের শেষে বিসর্গটি বাংলায় সাধারণত ও-কারের মতাে উচ্চারিত হয়। এই কারণে শব্দের শেষে বিসর্গটি লােপ করে অ-কারান্ত লেখা হয়। যেমন - সাধারণতঃ > সাধারণত (সাধারণততা), বিশেষতঃ > বিশেষত (বিশেষততা), বস্তুতঃ > বস্তুত (বস্তুতো)।
শব্দের মধ্যে বিসর্গ থাকলে, তার পরবর্তী ব্যঞ্জনটি উচ্চারণে দ্বিত্ব হয়। যেমন দুঃখ > দুখ, দুঃসাধ্য > দুসসাধ্য, নিঃসঙ্গ > নিসঙ্গ, নিঃশব্দ > নিশশব্দ ইত্যদি।
(চন্দ্রবিন্দু)
বাংলা বর্ণমালায় অন্যতম বর্ণ ৩ (চন্দ্রবিন্দু)। এই চিহ্নটি স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণের মাথায় যুক্ত হয়ে স্বরধ্বনির অনুনাসিকতা প্রকাশ করে। স্বতন্ত্র বর্ণ হিসাবে এর প্রয়ােগ নেই। স্বরাশ্রয়ী এই অনুনাসিক বর্ণটিকে তাই আশ্রয়স্থানভাগী বর্ণ বলা যেতে পারে। এটির উচ্চারণস্থান নাসিকা, তাই নাসিক্যবর্ণ। যে বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হয়, সেই বর্ণের অনুনাসিক উচ্চারণ হয়। যেমন আঁখি, আঁক, শাঁখ, ষাঁড়, হাঁস, দাঁত,
[মনে রাখবে: ঙ, ঞ, ণ, ন, ম, ং যুক্ত ব্যঞ্জনের দ্বারা গঠিত তৎসম শব্দের তদ্ভব রূপে ঙ, ঞ, , ন, ম, লােপ পায় এবং পূর্ববর্তী স্বরটি চন্দ্রবিন্দু যুক্ত হয়ে অনুনাসিক ও দীর্ঘ হয়ে যায়, তাকে নাসিক্যীভবন বলে। যেমন -শঙ্>শাঁখ, অঞ্চল>আঁচল, ষণ্ড>ষাঁড়, দন্ত>দাঁত, কম্পন>কাঁপন, বংশী>বাঁশী।
নাসিক্যধ্বনির (ঙ, ঞ,
ণ, ন, ম, ২) সঙ্গে কোন সংযােগ নেই এমন শব্দের উচ্চারণে যদি অনুনাসিকধ্বনি এসে পড়ে,
তখন তাকে স্বভােনাসিক্যীভবন বলে। যথা কাচ>কাঁচ, পুথি>পুঁথি, হাসপাতাল > হাঁসপাতাল,
পেচক > প্যাঁচা, উচ্চ > উচু ইত্যাদি।]