শিষ্ট চলিত-ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা (বাংলা ব্যাকরণ)

dream
0

 

শিষ্ট চলিত-ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

(বাংলা ব্যাকরণ)



চলিত-ভাষার উদাহরণ

১. তৎসম শব্দবহুল অথচ শ্রুতিমধুর গতিশীল চলিত-ভাষা: 

i.“বিশ্ব প্রাণের মূকধাত্রী এই গাছ নিরবচ্ছিন্ন কাল ধ'রে দ্যুলােককে দোহন করে পৃথিবীর অমৃত-ভাণ্ডারের জন্যে প্রাণের তেজ, প্রাণের রস, প্রাণের লাবণ্য সঞ্চয় করে; আর উৎকণ্ঠিত প্রাণের বাণীকে অহর্নিশি আকাশে উচ্ছসিত করে তােলে, ‘আমি থাকব। সেই বিশ্বপ্রাণের বাণী কেমন-এক-রকম করে আপনার রক্তের মধ্যে শুনতে পেয়েছিল ঐ বলাই।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ii.“সহসা হনুমান দেখতে পেলেন, সেই বৃক্ষের মূলে রাক্ষসী পরিবেষ্টিত একটি রমণী বসে আছেন, তাঁর দেহ উপবাসে কৃশ, রূপ ধূমজালমণ্ডিত অগ্নিশিখার ন্যায়, পরিধান একটি মাত্র মলিন পীতবসন। তিনি অশ্রুপূর্ণ-নয়নে বিষন্নবদনে বার বার দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। রাজশেখর বসু

iii.“বাঙালি লেখকদের কৃপায় বাংলা ভাষায় চক্ষুকর্ণের বিবাদ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। সেই বিবাদভঞ্জন করবার চেষ্টাটা আমি উচিত কার্য বলে মনে করি। সেই কারণেই এদেশের বিদ্যাদিগজের ‘স্থূলহস্তাবলেপ’ হতে মাতৃভাষাকে উদ্ধার করবার জন্য আমরা সাহিত্যকে সেই মুক্ত পথ অবলম্বন করতে বলি, যে পথের দিকে আমাদের সিদ্ধাঙ্গনারা উৎসুক-নেত্রে চেয়ে আছেন। -----প্রমথ চৌধুরী

২. তৎসম, দেশী-বিদেশী ও ধ্বন্যাত্মক শব্দের ব্যবহারে সহজ ও স্বচ্ছন্দ চলিত-ভাষা: 

i.“আর্য বাবাগণের জাঁকই কর, প্রাচীন ভারতের গৌরব ঘােষণা দিনরাতই কর; আর ; যতই কেন তােমরা ‘ডম্মম্ বলে ডই কর, তােমরা উচ্চবর্ণেরা কি বেঁচে আছ? তােমরা হচ্ছ দশ হাজার বছরের মমি!!...তােমাদের বাড়ি-ঘর-দুয়ার মিউজিয়ম, তােমাদের আচার-ব্যবহার, চাল-চলন দেখলে বােধ হয়, যেন ঠানদিদির মুখে গল্প শুনছি!"------- স্বামী বিবেকানন্দ

ii.....সেই ছেড়া গাড়ির আস্তাবল, সেই ধুলাে, সেই ঘড়ঘড় হুড়-মুড়, হৈ-হৈ, সেই মাছি ভন্ ময়রার দোকান, সেই ঘােরতর হিজিবিজি, হ-য-ব-র-ল’র মধ্যে সম্পূর্ণ আত্মবিসর্জন করতে চললুম। সেখানে তিন হাজার গিঞ্জের চুড়াে, কলের চিমনি, জাহাজের মাস্তুল নীল আকাশে যন গুতাে মারতে উঠেছে; কলকাতা তার সমস্ত লােকাষ্ঠ দিয়ে প্রকৃতিকে গঙ্গা পর করেছে – তার উপরে আবার এক পাঁচিল-দেওয়া নিমতলার ঘাট, মানুষের মরেও সুখ নেই।” ------রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

iii.‘‘হিন্দুরা তাদের মহারাজকে চিতায় তুলে দিতে চাইলে, আর নৌসেরা পাঠানের দল তাঁকে মুসলমানের মতাে কবর দিতে ব্যস্ত হল। শেষে যখন একপিঠে সূর্যের স্তব আর একপিঠে আল্লার দোয়া লেখা প্রকাণ্ড কিং খাবের চাদর বাপ্পার উপর থেকে খুলে নেওয়া হল, তখন সেখানে আর কিছুই দেখা গেল না কেবল রাশি-রাশি পদ্মফুল আর গােলাপফুল।"------অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

iv. “সবচেয়ে চিত্তির যখন হঠাৎ বাঁক নিয়ে সামনে দেখতে পাবেন আধ মাইল লম্বা উটের লাইন। একদিকে পাহাড়ের গা, আর একদিকে হাজার ফুট গভীর খাদ, মাঝখানে গাড়ি বাদ দিয়ে রাস্তার ক্লিয়ারিং এক হাত। তার ভিতর দিয়ে নড়বড়ে উট দুরের কথা, শান্ত গাধাও পেরতে পারে না।” 

                                                                                                  -------------সৈয়দ মুজতবা আলি

 

সাধু-ভাষা থেকে চলিত-ভাষা:

(ক) সাধু - রাজা, এই কৌতুক দেখিতে দেখিতে ক্রমে ক্রমে অগ্রসর হইয়া, তাঁহাদের অতি নিকটে উপস্থিত হইলেন; কিন্তু সহসা তাঁহাদের সম্মুখে না গিয়া, এক বৃক্ষের অন্তরালে থাকিয়া, সস্নেহ নয়নে সেই শিশুকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন।

চলিত- রাজা, এই কৌতুক দেখতে দেখতে ক্রমে ক্রমে অগ্রসর হয়ে তাঁদের অতি নিকটে উপস্থিত হলেন, কিন্তু, সহসা তাঁদের সম্মুখে না গিয়ে, এক বৃক্ষের অন্তরালে থেকে, সস্নেহ নয়নে সেই শিশুকে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন।

(খ) সাধু - ‘‘অশ্বারােহী নিঃশব্দে লক্ষ্য করিতে লাগিল, উহারা কোন্ পথে যায়। তাহারা যখন নদীর বাঁক ফিরিয়া পর্বতান্তরালে অদৃশ্য হইল, তখন অশ্বারােহী অশ্ব হইতে নামিল।” ---------বঙ্কিমচন্দ্র

চলিত- অশ্বারােহী নিঃশব্দে লক্ষ্য করতে লাগল, ওরা কোন্ পথে যায়। তারা যখন নদীর বাঁক ফিরে পর্বতান্তরালে অদৃশ্য হল, তখন অশ্বারােহী অশ্ব থেকে নামল।

(গ) সাধু - “যদি আমাদের দেশের শিক্ষায় ছাত্রদিগকে চাকরি ছাড়া অন্যান্য জীবিকার সংস্থানে পটু করিয়া তুলিত তাহা হইলে এই সম্বন্ধে নালিশের কথা থাকিত না। কিন্তু পটু না করিয়া সর্বপ্রকারে অপটুই করিতেছে, এ কথা আমরা নিজের প্রতি তাকাইলে বুঝিতে পারি।”------- রবীন্দ্রনাথ 

চলিত- যদি আমাদের দেশের শিক্ষায় ছাত্রদের চাকরি ছাড়া অন্যান্য জীবিকার সংস্থানে পটু করে তুলত তা হলে এ সম্বন্ধে নালিশের কথা থাকত না। কিন্তু পটু না করে সর্বপ্রকারে অপটুই করছে, এ কথা আমরা নিজের দিকে তাকালে বুঝতে পারি। -

(ঘ) সাধু- “পুলিশ-স্টেশনে প্রবেশ করিয়া দেখা গেল, সুমুখের হল-ঘরে জন-ছয়েক বাঙালী মােট-ঘাট লইয়া বসিয়া আছে, জগদীশবাবু, ইতিমধ্যেই তাহাদের টিনের তােরঙ্গ ও ছােট বড় পুঁটলি খুলিয়া তদারক শুরু করিয়া দিয়াছেন।” -------- শরৎচন্দ্র

চলিত - পুলিশ-স্টেশনে ঢুকে দেখা গেল, সুমুখের হল-ঘরে জন-ছয়েক বাঙালী মােট-ঘাট নিয়ে বসে আছে, জগদীশবাবু ইতিমধ্যেই তাদের টিনের তেরঙ্গ ও ছােট-বড় পুঁটলি খুলে তদারক শুরু করে দিয়েছেন।

(ঙ) সাধু - ‘অপুদের বাড়ি হইতে কিছু দূরে একটা খুব বড়াে অশ্বত্থ গাছ ছিল। কেবল তাহার মাথাটা উহাদের দালানের জানালা কি রােয়াক হইতে দেখা যায়। অপু মাঝে মাঝে সেইদিকে চাহিয়া দেখিত।”                                                                                                        --------বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

চলিত- অপুদের বাড়ি থেকে কিছু দূরে একটা খুব বড়াে অশথ গাছ ছিল। কেবল তার মাথাটা ওদের দালানের জালা কি রােয়াক থেকে দেখা যায়। অপু মাঝে মাঝে সেদিকে চেয়ে দেখত।

চলিত-ভাষা থেকে সাধু-ভাষা:

(ক) চলিত- “কলকাতায় ফিরে গিয়ে কি আর আপনার সঙ্গে দেখা হতে পারে না? আপনি কি এখন ইহজন্মের মতাে সব-ডেপুটিপুরে প্রয়াণ করলেন ? শীঘ্র আর মুক্তির ভরসা নেই। আইনের গলগ্রহ গলায় বেঁধে আপনি কি তা হলে সর্বিস-সরােবরে একরকম ডুব মারলেন? ---------রবীন্দ্রনাথ

সাধু - কলিকাতায় ফিরিয়া গিয়া কি আর আপনার সহিত দেখা হইতে পারে ? আপনি কি এখন ইহজন্মের মতাে সব-ডেপুটিপুরে প্রয়াণ করিলেন? শীঘ্র আর মুক্তির ভরসা নাই। আইনের গলগ্রহগলায় বাঁধিয়া আপনি কি তাহা হইলে সর্বিস-সরােবরে একপ্রকার ডুব মারিলেন ?

(খ) চলিত “তােমরা শূন্যে বিলীন হও, আর নূতন ভারত বেরুক। বেরুক লাঙল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে-মালা, মুচি-মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে।” ----------স্বামী বিবেকানন্দ

সাধু- তােমরা শুন্যে বিলীন হও, আর নূতন ভারত বাহির হউক। বাহির হউক লাঙল ধরিয়া, কৃষকের কুটির ভেদ করিয়া, জালিয়া-মালা-মুচি-মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হইতে।

(গ) চলিত- “রাণা। বিনয়ী বটে। শােন আমি এমন একটা কাজ কর্তে তােমায় ডেকেছি, যা তুমি ছাড়া আর কেউ কর্তে পারে না।” --------- দ্বিজেন্দ্রলাল রায় 

সাধু - রাণা। বিনয়ী বটে। শােন। আমি এমন একটি কাজ করিতে তােমাকে ডাকিয়াছি যাহা তুমি ছাড়া আর কেহ করিতে পারিবে না। 

(ঘ) চলিত “ভােরের নমাজ শেষ হতেই সদারজী ভেঁপু বাজাতে আরম্ভ করলেন। ভাবগতিক দেখে মনে হল তিনি মনস্থির করে ফেলেছেন আজ সন্ধ্যেয় যে করেই হােক কাবুল পৌঁছবেন।” 

                                                                                                  -----------সৈয়দ মুজতবা আলি

সাধু- ভােরের নমাজ শেষ হইতেই সদারজী ভেঁপু বাজাইতে আরম্ভ করিলেন। ভাবগতিক দেখিয়া মনে হইল তিনি মনস্থির করিয়া ফেলিয়াছেন আজ সন্ধ্যায় যেমন করিয়াই হউক কাবুল পৌঁছাইবেন।

[মনে রাখবে: লেখার সময় সাধু ও চলিত-ভাষার যেন মিশ্রণ না ঘটে। হয় সাধু নয় চলিত যে কোন একটি রীতিতে লিখবে। একই লেখার মধ্যে সাধু ও চলিতের মিশ্রণ ঘটলে গুরুচণ্ডালী দোষ বলে। যেমন তাঁহারা শব পােড়াতে চলিলেন। শুদ্ধ করে লিখলে হবে (ক) তাঁহারা শবদাহ করিতে চলিলেন। (খ) তাঁরা মড়া পােড়াতে চললেন।]



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top