মাধ্যমিক তৃতীয় অধ্যায় ( 8 নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর)

0

মাধ্যমিক তৃতীয় অধ্যায় ( 8 নম্বরের প্রশ্ন  ও উত্তর)




1.ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য কি ছিল বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো এবং এর  চরিত্র ও গুরুত্ব আলোচনা করো
ওয়াহাবি আন্দোলন : ভারতবর্ষে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করেন দিল্লির বিখ্যাত মুসলিম সন্ত শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও তার পুত্র আজিজ। তবে ভারতবর্ষে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রায়বেরিলির অধিবাসী সৈয়দ আহমেদ।
ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য :
i.    ইসলামধর্মের সংস্কার : ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত নাম হল তারিকা-ই-মহম্মদীয়া’ অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মহম্মদ প্রদর্শিত পথ। ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ইসলামধর্মের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কার দূর করে মহম্মদের নির্দেশ অনুসরণ করে ইসলামধর্মের সংস্কার করা।
ii.    ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজদের বিতাড়ন : ওয়াহাবি আন্দোলনকারীরা বিধর্মী ইংরেজ-শাসিত ভারতকে দার-উল-হারব’ (শত্রুর দেশ) বলে অভিহিত করত। তাই তারা ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে ভারতবর্ষ থেকে বিধর্মী ইংরেজদের বিতাড়িত করার জন্য আন্দোলন করেছিল।
iii.   অত্যাচারী জমিদারদের উচ্ছেদ : ওয়াহাবি আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল অত্যাচারী জমিদারদের উচ্ছেদ করা। এই কারণে পাঞ্জাবের অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে সৈয়দ আহমেদ যুদ্ধ করে পেশোয়ার দখল করেছিলেন এবং বাংলায় তিতুমির পুড়ার জমিদারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।
iv.   নৈতিক ও আধ্যাত্মিক আদর্শ: ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল এক সহজসরল জীবনযাত্রা এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক আদর্শের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
তিতুমিরের নেতৃত্বে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন: বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন মির নিশার আলিযিনি তিতুমির নামে অধিক পরিচিত। তিতুমির ২৪ পরগনা জেলার বাদুড়িয়া থানার অন্তর্গত হায়দারপুর গ্রামের এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ৩৯ বছর বয়সে মক্কায় হজ করতে গিয়ে সৈয়দ আহমদের সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং দেশে ফিরে ইসলামধর্মের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই আন্দোলন কৃষক আন্দোলন’-এ পরিণত হয়েছিল। বারাসত অঞলে তিতুমিরের এই আন্দোলন বারাসত বিদ্রোহ’ নামেও পরিচিত।
 তিতুমিরের আন্দোলনের মূল কথা: তিতুমিরের আন্দোলনের মূল কথা ছিল
                        V.     একমাত্র আল্লাহকে মান্য করতে হবে।
                       VI.     মুসলমানদের ইসলামধর্মবহির্ভূত সংস্কার পরিত্যাগ করতে হবে।
                      VII.     অনুগামীদের দাড়ি রাখতে হবে।
                      VIII.     অত্যাচারী জমিদারদের রাজস্ব দাবির বিরোধিতা করতে হবে।
তিতুমিরের বিরুদ্ধে জমিদারদের প্রতিক্রিয়া : তিতুমিরের প্রভাবে ২৪ পরগনানদিয়ামালদহরাজশাহিঢাকা প্রভৃতি অঞ্চলের কৃষকরা ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করলে জমিদারনীলকর সাহেব ও মুসলমান মোল্লারা তিতুমিরের বিরোধিতা শুরু করে। পুড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব  রায় তিতুমিরের অনুগামীদের দমন করার জন্য দাড়ির উপর ২.৫ টাকা কর ধার্য করেছিলেন। ফলে জমিদারের সঙ্গে তিতুমিরের অনুগামীদের সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল।
বারাসত বিদ্রোহ : তিতুমির বারাসতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিজেকে স্বাধীন বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেছিলেন ও মইনউদ্দিন নামে এক অনুগামীকে প্রধানমন্ত্রী এবং ভাগ্নে গোলাম মাসুমকে প্রধান  সেনাপতি নিযুক্ত করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করার পরিকল্পনা করেন। তিনি নারকেলবেড়িয়ার সদর দপ্তরে বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে ওই অঞ্চলের জমিদারদের কাছে রাজস্ব দাবি করেন। এটি ইতিহাসে বারাসত বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত।
বারাসত বিদ্রোহের অবসান : তিতুমিরের বিরুদ্ধে স্থানীয় জমিদার ও নীলকর সাহেবরা গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্কের শরণাপন্ন হলে 1831 খ্রিস্টাব্দে লর্ড বেন্টিং তার বিরুদ্ধে  এক অভিযান প্রেরন করেন এবং কামানের আঘাতে বাঁশেরকেল্লা ধ্বংস হয়। তিতুমীর ও তার কয়েকজন অনুগামী বীরের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেন বন্দি সৈন্যদের ফাঁসি হয় এবং অনেকে দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ড ভোগ করেন।
তিতুমীরের আন্দোলনের চরিত্র :  তিতুমিরের আন্দোলনের চরিত্র নিয়েও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। সমকালীন লেখক বিহারীলাল সরকারকুমুদনাথ মল্লিক তিতুমিরের আন্দোলনকে ধর্মোন্মাদ মুসলমানদের কাণ্ড’ এবং হিন্দু-বিরোধী আন্দোলন বলে চিহ্নিত করেছেন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার একে নিছক সাম্প্রদায়িক আন্দোলন বলেছেন।  অপরপক্ষে হান্টারথর্নর্টন প্রমুখ ঐতিহাসিক এতে কোন সাম্প্রদায়িকতা দেখতে পাননি। ডব্ল. সি. স্মিথ,  ডঃ কুয়েমুদ্দিন আহমদনরহরি কবিরাজ  প্রমুখ এর মধ্যে জমিদারনীলকর ও ইংরেজ বিরোধিতা লক্ষ্য করেছেন। ড. বিনয়ভূষণ চৌধুরী  বলেন যেতিতুমিরের সংগ্রাম ছিল জমিদারের অনাচারের বিরুদ্ধে। সে যুগে জমিদারদের অধিকাংশই হিন্দু হওয়ায় এই আন্দোলনকে হিন্দু-বিরোধী বলে মনে হতে পারেকিন্তু মুসলিম জমিদারদের তিনি ছেড়ে দেননি। নিম্নবর্ণের বহু হিন্দু তাকে সমর্থন করত।
গুরুত্ব: ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ওয়াহাবি আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। তিতুমিরের নেতৃত্বে পরিচালিত ওয়াহাবি আন্দোলন ধর্মসংস্কার আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও এটি কৃষক বিদ্রোহের রূপ পরিগ্রহণ করেছিল। অত্যাচারী জমিদার ও নীলকর সাহেবদের হাতে নির্যাতিত মানুষদের সংগঠিত করে তিতুমির বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক প্রেরিত ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি প্রাণপণ সংগ্রাম করেছিলেন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন যেতিতুমিরের বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটানো। ড. শশীভূষণ চৌধুরী বলেছেন যেএই বিদ্রোহের মূল চালিকাশক্তি ছিল কৃষকরা এবং এই বিদ্রোহ ছিল আসলে ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত কৃষক বিদ্রোহ।যাইহোক পরবর্তীকালে এই আন্দোলনে ধর্মীয় স্পর্শ লক্ষ্য করা গেলেও এই আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম দরিদ্র কৃষক জমিদার নীলকর সাহেব এবং ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় এবং হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ে ভারতে এক মিশ্র-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল।তাই এই আন্দোলনের গুরুত্ব কে অস্বীকার করা যায় না।


2.কোল বিদ্রোহের কারণ ফলাফল ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো
ভুমিকাঃ- কোলরা বিহারের ছোটনাগপুর অঞ্চলে বসবাসকারী এক উপজাতি। তারা ইংরেজ, মহাজন বা বহিরাগত দিকুদের  বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করেছিল তা কোল বিদ্রোহ নামে পরিচিত 1820 খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিদ্রোহ করে।  তবে 1831-1832 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল
 বিদ্রোহের কারণ:- কোল বিদ্রোহের পিছনে নানাবিধ কারণ ছিল-
(i) রাজস্ব বৃদ্ধি : 1820 খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছোটোনাগপুরের শাসন কর্তৃত্ব লাভ করে। অতঃপর তারা ওই অঞলটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে বহিরাগত জমিদার বা দিকুদের জমি ইজারাদান করে। এরা রাজস্বের পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি করলে কোলদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে।
(ii) নগদে খাজনা প্রদান-: কোম্পানি নগদ অর্থে খাজনা প্রদানের নিয়ম চালু করলে কোলরা ফসল বিক্রি করতে গিয়ে মহাজন ও ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতারিত হয়
(iii) মহাজনদের শোষণ -: অসহায় কোলরা রাজস্ব প্রদান ও জীবন রক্ষার তাগিদে মহাজনদের কাছে উচ্চহারে ঋণগ্রহণ করে ঋণের জালে জড়িয়ে সর্বস্বান্ত হয়।
(iv) জমি থেকে উৎখাত -: মাত্রাতিরিক্ত রাজস্ব জনিত কারণে অসহায় কোলরা রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হলে তাদের জমি থেকে উৎখাতও করা হত।
(v) বেগার শ্রম -: দরিদ্রদীনদুঃখী কোলদের রাস্তাঘাট ইত্যাদির জন্য বেগার শ্রম অর্থাৎ বিনা পারিশ্রমিকে শ্ৰমদানে বাধ্য করা হলে তারা অসন্তুষ্ট হয়।
(vi) আফিম চাষে বাধ্য করা -: কোলদের ইচ্ছার বিরদ্ধে সরকার নিজেদের স্বার্থে লাভজনক আফিম চাষে বাধ্য করলে তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
বিদ্রোহের সূচনা : কোলদের উপর শোষণ ও অত্যাচারের প্রতিবাদে বুন্তু ভগতজোয়া ভগতসুই মুণ্ডা ও ঝিন্দরাই মানকি কোলদের সমবেত করতে থাকেন। 1831 খ্রিস্টাব্দে রাঁচি জেলায় মুণ্ডা ও ওঁরাও সম্প্রদায়ের কৃষকরা সর্বপ্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে। রাঁচিসিংভূমহাজারিবাগপালামৌ ও মানভূমের পশ্চিম অঞ্চল কোল বিদ্রোহের প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। কোলরা ছিল ভয়ানক সাহসী, তারা সীমাহীন নিষ্ঠুরতার আশ্রয় গ্রহণ করে তির-ধনুককুড়ুল হাতে নিয়ে  ইংরেজ, জোতদারজমিদারশস্য ব্যবসায়ীমহাজনইংরেজ কর্মচারী এমনকি আদিবাসী নন এমন কোনো মানুষই তাদের আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায়নি।
বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য : কোল বিদ্রোহের একাধিক বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়-
             I.  কোলরা এই বিদ্রোহ গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল। যেমন— আমগাছের শাখা গ্রামে গ্রামে পাঠানো হত।
            II.  যুদ্ধের জন্য তির বিলি করা হত।
           III.  বিদ্রোহীদের হাতে ধৃত মহাজনদের দেবতার সামনে নিয়ে গিয়ে বলি দেওয়া হত।
           IV.  বিদ্রোহীরা সীমাহীন নিষ্ঠুরতার আশ্রয় গ্রহণ করেছিল।
            V.  তারা ব্রিটিশ সরকারকে অগ্রাহ্য করে নিজেদের সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে।
           VI.  গণসমর্থন ছিল এই বিদ্রোহের শক্তির প্রধান উৎস
ফলাফল ও গুরুত্ব : কোল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর গুরুত্ব অপরিসীম।
             I.   এই বিদ্রোহের তীব্রতাব্যাপকতা লক্ষ্য করে সরকার 1834 খ্রিস্টাব্দে কোলদের জন্য দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তু এজেঙ্গি’ নামে একটি পৃথক অঞ্চল গড়ে তোলে।
            II.   এখানে ব্রিটিশ আইনের পরিবর্তে কোলদের নিজস্ব আইনকানুন বহাল রাখার ব্যবস্থা হয়।
           III.   জমিদারদের কেড়ে নেওয়া জমি তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
           IV.   এই বিদ্রোহ পরবর্তীকালের কৃষক বিদ্রোহ গুলিকে অনুপ্রাণিত করে ইত্যাদি।।

3.চুয়াড় বিদ্রোহ সম্পর্কে টীকা লেখ।
অথবা চুয়াড় বিদ্রোহের কারন, বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব  আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ- ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে মেদিনীপুরে উত্তর-পশ্চিম দিক ‘জঙ্গলমহল’ নামে পরিচিত ছিল। এখানে বসবাসকারী অধিবাসিদের চূয়াড় বলা হত। বাকুড়া, পুরুলিয়া ও ধলভূম ছিল জঙ্গলমহলে অন্তর্গত। 1768 -1769 এবং 1798 1799 সালে চুয়াড়রা যে বিদ্রোহ করেছিল তা চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
চুয়াড় বিদ্রোহের কারনঃ-  চুয়াড় বিদ্রোহের কারণগুলি হল-
a.    উচ্চহারে রাজস্ব আদায়ঃ-চুয়াড়রা কৃষিকাজ ও পশু পালন করলেও তারা পাইকদের অধীনে আধাসামরিক কাজ করত ও পাইকান জমি পেত। ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার মাধ্যমে কোম্পানি পাইকান জমির ওপর উচ্চহারে রাজস্ব ধার্য করে ফলে অত্যধিক রাজস্বের চাপ ও রাজস্ব আদায় কারীদের সীমাহিন অত্যাচার তাদের ক্ষিপ্ত ক্রে তোলে।
b.     জীবিকা সমস্যাঃ-চুয়াড়দের প্রধান জীবিকা ছিল পাইক দের অধীনে থেকে পাইকান জমিতে কৃষি কাজ করা বেতনের পরিবর্তে তারা নিষ্কর জমি ভোগ করত। সরকারি পাইকান জমি কেড়ে নিলে তাদের জীবিকা দুর্বিষহ হয়ে পড়ে ও তারা বিদ্রোহের দিকে এগিয়ে যায়।
c.   সূর্যাস্ত আইনঃ-1793 সালে প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারগণদের বছরের নির্দিষ্ট দিনে সূর্য ডোবার আগে রাজস্ব দিতে হতো, তা না হলে চুয়াড়দের জমি কেড়ে নিত। এটি সূর্যাস্ত আইন নামে পরিচিত। এরপর নিলামের দ্বারা তা অন্য জমিদারদের হস্তক্ষেপ হত ফলে জমিদার ও কৃষকরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
             উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে 1768 খ্রিস্টাব্দে ধলভূমের রাজা জগন্নাথ সিংহ প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে। পরে আবার 1798-1799 খ্রিস্টাব্দে দুর্জন সিংহের নেতৃত্বে চুয়াড় বিদ্রোহ ঘটে।
চুয়াড় বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্যঃ-
a.   সশস্ত্র বিদ্রোহঃ-এই বিদ্রোহ ছিল একটি সশস্ত্র বিদ্রোহ এই বিদ্রোহ বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার হয় বলা হয় যে কর্নগড়ের রানী শিরোমণি ও নাড়াজালের রাজারা আড়াল থেকে গোলাবারুদ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেন।
b.    ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহঃ-চুয়াড় বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ বিরোধী অভ্যুত্থান। অন্যান্য বিদ্রোহে কৃষকরা জমিদারদের ওপর ক্ষিপ্ত হয় কিন্তু এই বিদ্রোহ ছিল কৃষক ও জমিদারদের মিলিত ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।
c.   দীর্ঘস্থায়ী বিদ্রোহঃ-এই বিদ্রোহ ছিল একটি দীর্ঘস্থায়ী বিদ্রোহ 1768 1799 সাল পর্যন্ত প্রায় 30 বছর পর্যন্ত এই বিদ্রোহ চলেছিল।
d.   বিস্তৃত বিদ্রোহঃ-এই বিদ্রোহ বিশাল এলাকা নিয়ে হয়েছিল বিদ্রোহের আগুন মেদিনীপুর থেকে প্রায় 100 গ্রামে এবং বাঁকুড়া ধলভূম পুরুলিয়া বীরভূম ছড়িয়ে পড়ে।
চুয়াড় বিদ্রোহের গুরুত্বঃ-
চুয়াড় বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এই বিদ্রোহের বিভিন্ন গুরুত্ব ছিল-
A.  নিরক্ষর চুয়াড় বিদ্রোহ ভারতের শিক্ষিত সমাজের চোখ খুলে দেয়।
B.   এই বিদ্রোহ ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে জমিদারকে ঐক্যবদ্ধ হয়।
C.  এই বিদ্রোহ ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে জমিদার ও কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হয়।
D.  বিদ্রোহের পর সরকার দুর্গম বনাঞ্চল নিয়ে জঙ্গলমহল নামে একটি জেলা গঠন করে
উপসংহারঃ-চুয়াড় বিদ্রোহের কারণ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে এর স্বতন্ত্র চরিত্র পাওয়া যায়। চুয়াড় বিদ্রোহ ছিল ঔপনিবেশিক আইনের বিরুদ্ধে তাদের অধিকার রক্ষার লড়াই। আদিবাসীরা এই বিদ্রোহে অংশ নিলেও নরহরি কবিরাজ এর মতে কৃষকরাই ছিল এর প্রধান স্তম্ভ। সেই কারণে ইতিহাসে এই বিদ্রোহটি গুরুত্বপূর্ণ

4.পরাধীন ভারতবর্ষে কি কারনে নীল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল? এই বিদ্রোহের গুরুত্ব কি?
অথবা নীল বিদ্রোহের কারণ ও গুরুত্ব আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ- নীল চাষ ভারতের একটি প্রাচীন চাষ। বাংলার নীলচাষিরা 1859 খ্রিস্টাব্দে নীলচাষ তথা নীলকর সাহেবদের যে বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, তা ‘নীল বিদ্রোহ’নামে পরিচিত।
নীল বিদ্রোহের কারণ:-নীল বিদ্রোহের পিছনে একাধিক কারণ সক্রিয় ছিল। যথা—
 i)নীলকরদের অত্যাচার:- নীলকররা নীলচাষিদের নানাভাবে অত্যাচার করে নীলচাষ করতে বাধ্য করত। অনিচ্ছুক চাষিদের প্রহার করা, আটকে রাখা, স্ত্রী-কন্যার সম্মানহানি করা, চাষের সরঞ্জাম লুঠ করা, ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া প্রভৃতি নানাভাবে চাষিদের অত্যাচার করত।
ii) দাদন প্রথা :- নীলকররা চাষিদের দাদন বা অগ্রিম অর্থ দিত। অভাবের সময় চাষিরা অগ্রিম নিত। প্রতি বিঘায় ২ টাকা অগ্রিম দিয়ে চাষির সবচেয়ে ভালো জমিতে নীলচাষ করাতে বাধ্য করত। একবার কেউ দাদন নিলে সে আর নীলচাষের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারত না।
iii) প্রতারণা ও কারচুপি:- নীলকররা নীলচাষিদের বিভিন্নভাবে প্রতারিত করত। নীল কেনার সময় নীলের ওজন কম দেখাত, কম দামে নীল বিক্রি করতে বাধ্য করত; তা ছাড়া জোর করে বিভিন্নভাবে অর্থ আদায় করত।
iv) পঞ্চম আইন :- 1830 খ্রিস্টাব্দে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক পঞম আইন পাস করে ঘোষণা করেন যে, কোনো চাষি দাদন নিয়ে নীলচাষ না করলে তাকে গ্রেফতার করা হবে ও তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। এর ফলে নীলচাষিদের উপর অত্যাচার অনেক বেড়েছিল।
 v) অবিচার:- অত্যাচারিত নীলচাষিরা আদালতে গিয়েও সুবিচার পেত না। আইন ছিল নীলকরদের স্বার্থরক্ষার জন্য, চাষিদের জন্য নয়। তাছাড়া পুলিশ, প্রশাসন সবই ছিল নীলকরদের পক্ষে।
vi) পত্রপত্রিকার প্রভাব :- নীলচাষিদের উপর নীলকরদের অবর্ণনীয় অত্যাচারের কথা সে সময়কার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও লেখায় প্রকাশিত হয়েছে। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা এবং দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ' নাটক-এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।
             উপরোক্ত কারণগুলির ফলস্বরূপ নীলচাষিরা বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের নেতৃত্বে নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। নীল বিদ্রোহের প্রথম সূচনা হয় তৎকালীন নদিয়া জেলার চৌগাছা গ্রামে। ক্রমে এই বিদ্রোহ বর্ধমান, বাঁকুড়া, মালদা, মুরশিদাবাদ, দিনাজপুর, পাবনা, ফরিদপুর, খুলনা প্রভৃতি অঞলে ছড়িয়ে পড়ে।

নীল বিদ্রোহের ফলাফল/তাৎপর্য/গুরুত্বঃ-
i)এই বিদ্রোহের ফলে সরকার 1860 খ্রিস্টাব্দের 31 ডিসেম্বর নীল তদন্ত কমিশন গঠিত হয়।
ii)কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী 1868 খ্রিস্টাব্দে নীল চুক্তি আইন’রদ করা এবং নীলচাষ সম্পূর্ন চাষীদের ইচ্ছাধীন হয়। নীলকররা এখানে নীলচাষে অর্থ বিনিয়োগ বন্ধ করে বিহার ও পার্বত্য এলাকায় চা শিল্পে বিনিয়োগ করতে শুর করে।
 iii)নীল বিদ্রোহের সাফল্য বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রসারে সহায়তা করেছিল। শিশির কুমার ঘোষ লিখেছেন, “নীল বিদ্রোহই সর্বপ্রথম - ভারতবাসীকে সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা শিখিয়েছিল”।

এই বিদ্রোহে এমন কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ছিল যা অন্যান্য বিদ্রোহগুলিতে ছিল না।
নীল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য :
a.   নীলকরবিরোধী বিদ্রোহ:- নীল বিদ্রোহ ছিল নীলকরবিরোধী বিদ্রোহ এটি অন্যান্য বিদ্রোহের মতো জমিদার বা মহাজনবিরোধী বিদ্রোহ ছিল না। নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচার ও জোরজবরদস্তির বিরুদ্ধে নীলচাষিরা সংঘবদ্ধ হয়েছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল নীলচাষ প্রথার পুরোপুরি অবসান ঘটানো।
b.   কৃষকদের কঠোর মনোভাব:- নীল বিদ্রোহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল কৃষকদের কঠোর মনোভাব। এই বিদ্রোহে কৃষকরা দৃঢ়তার সঙ্গে মনস্থির করেছিল যে, মরব তবু নীলচাষ করবনা। শেষপর্যন্ত বিদ্রোহী কৃষকরা বাংলা থেকে নীলচাষ বন্ধ করেছিল।
c.   আন্দোলনে প্রথম ধর্মঘটের প্রয়োগ:- এল নটরাজন বলেছেন, নীলচাষ করতে অস্বীকার করে বাংলার কৃষকরা ভারতের ইতিহাসে প্রথম ধর্মঘটের নজির সৃষ্টি করে। ভারতে কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে এই ঘটনা ছিল অভিনব।
d.   ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্রোহ :- ওয়াহাবি, ফরাজি, সাঁওতাল, মুণ্ডা প্রভৃতি বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি ছিল ধর্ম। কিন্তু নীল বিদ্রোহে তা  ছিল না।নীল বিদ্রোহ ছিল মূলত কৃষকদের অধিকার রক্ষার বিদ্রোহ। নীল বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলমান সব সম্প্রদায়ের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে শামিল হয়েছিল।
e.   বিদ্রোহে খ্রিস্টান মিশনারিদের সমর্থনঃ- নীল বিদ্রোহে খ্রিস্টান মিশনারিরা  বিদ্রোহীদের সমর্থন করেছিল। তারা নীলচাষিদের উপর নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিল। জেমস লঙ নীলদর্পণ নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এজন্য তাঁকে জেলেও যেতে হয়েছিল।
  পরিশেষে বলা যায়, নীল বিদ্রোহ বাঙালি সমাজে ব্যাপক চাঞ্চল্য ও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় নীলচাষিদের বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিল। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তার হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় নীলচাষিদের সমর্থনে নিয়মিত লেখা প্রকাশ করতেন। তা ছাড়া অন্যান্য পত্রপত্রিকা ও নাটকে যেভাবে নীল বিদ্রোহকে সমর্থন করা হয়েছিল তা ছিল অভূতপূর্ব।

5.হাজি শরিয়ৎ উল্লাহ কে ছিলেন? তার মতাদর্শ কি? 
অথবা ফরাজি আন্দোলনের উপর একটি প্রবন্ধ রচনা কর। 

ভূমিকাঃ- একজন বিখ্যাত ধর্মসংস্কারক এবং ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে সংঘটিত ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়তুল্লাহ 1781 খ্রিস্টাব্দে বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার বাহাদুরপুর গ্রামে এক কৃষকপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা, মক্কা ও কায়রোয় দীর্ঘকাল কোরান ও ইসলামী ধর্মতত্ত্বের পাঠগ্রহণ করেন এবং ধর্ম সংস্কারক-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
আদর্শঃ- আরবি ভাষায় ‘ফরাজি’ কথার অর্থ হল ইসলাম-নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য। শরিয়উল্লাহ ঘোষণা করেন যে, ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরে ইসলাম-বিরোধী নানা কুসংস্কার ও দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কোরানের নিদের্শ যথার্থভাবে পালন করে তিনি ইসলাম ধর্মের সংস্কার সাধনের কথা বলেন। ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও অচিরেই এই আন্দোলন রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষকে তিনি ‘দার-উল-হারব’ বা শত্রুর দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন যে, এই দেশ ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের বাসের যোগ্য নয়। তিনি জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন এবং অচিরেই বরিশাল, ময়মনসিংহ, ঢাকা ও ফরিদপুরের লক্ষ লক্ষ দরিদ্র মুসলিম চাষি, কারিগর ও বেকার তাতি তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। এইভাবে বাংলার কৃষকদের মধ্যে এক জাগরণের সৃষ্টি হয় এবং তারা জমিদারের অন্যায় অত্যাচার ও জুলুমের প্রতিবাদ জানাতে সাহসি হয়।
দুদু মিঞার ভূমিকাঃ- 1837 খ্রিস্টাব্দে শরিয়ত উল্লাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দুদু মিঞা (মহম্মদ মহসীন) 1860 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফরাজি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তিনি বাহাদুরপুরে প্রধান কার্যালয় স্থাপন করে, লাঠিয়াল ও গুপ্তচর বাহিনী গঠন করেন এবং  জমিদার নীলকরদের বিরুদ্ধে আক্রমণ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করে ফরাজি আন্দোলনকে ধর্মীয় আন্দোলন থেকে আর্থ সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে উন্নীত করেন। আতঙ্কিত জমিদার, মহাজন, নীলকরদের চাপে 1838 খ্রিস্টাব্দে,1841 খ্রিস্টাব্দে এবং 1857 খ্রিস্টাব্দে দুদু মিঞাকে গ্রেপ্তার করা হলেও প্রমাণ না পাওয়ায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। 1860 খ্রিস্টাব্দে দুদু মিঞার মৃত্যুর পর তার পুত্র নোয়া মিঞা এই আন্দোলনে ধর্মীয় আদর্শকে গুরুত্ব প্রদান করলে এই আন্দোলনের গুরুত্ব কমে যায়।

প্রকৃতিঃ- ঢাকা, বরিশাল, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা প্রভৃতি জেলায় এই আন্দোলন বিস্তার লাভ করে। ফরাজি আন্দোলন ইসলাম ধর্মের সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্যে। শুরু হলেও ক্রমশ তা জমিদার-বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। অধিকাংশ জমিদাররাই হিন্দু হলেও ফরাজি আন্দোলন সম্পূর্ণভাবে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক আন্দোলন ছিল না, কারণ এই আন্দোলনে মুসলমান কৃষকদের পাশাপাশি বহু হিন্দু কৃষকও শামিল হয়েছিল।

ব্যর্থতার কারণঃ-  দুদু মিঞার মৃত্যুর পর যোগ্য নেতৃত্বের অভাব, ধর্মীয় সংকীর্ণতা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। এ ছাড়া সাধারণ লোককে জোর করে দলভুক্ত করা, অর্থ আদায়, সরকারি দমননীতি প্রভৃতি কারণে ফরাজি আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যায়।
 গুরুত্বঃ- ফরাজি আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেও ব্রিটিশ বিরোধী কৃষক আন্দোলন হিসেবে এই আন্দোলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ড. অভিজিৎ দত্ত বলেছেন, ফরাজিরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উচ্ছেদ করতে না পারলেও বাংলা থেকে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ কামনা করেছিল।

6.ভারতে ফরাজী ওয়াহাবী আন্দোলনের তুলনামূলক আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ-ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় হিন্দু জমিদার ও ব্রিটিশ শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে নিম্নবর্গীয় মুসলিম সমাজ একাধিক ধর্মীয় আন্দোলনে লিপ্ত হয়েছিল। এই ধর্মীয় আন্দোলনগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল ফরাজি এবং ওয়াহাবি বা তরিকা-ই-মহম্মদীয়া আন্দোলন।আপাতদৃষ্টিতে দুটি আন্দোলনই হিন্দু জমিদার ও শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত ধর্মীয় আন্দোলনরূপে প্রতিভাত হলেও বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে এদের প্রকৃতি ছিল পরস্পরের থেকে ভিন্ন।
ফরাজি ও ওয়াহাবি আন্দোলনের পারম্পরিক সাদৃশ্য হল-
1.   সূচনালগ্নে উভয় আন্দোলনের ভিত্তিই ছিল কোরান।
2.   ওয়াহাবি আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ইসলামের পুনরুজ্জীবন। উভয় আন্দোলনই ধর্মযুদ্ধের দ্বারা এই দেশকে ইসলামের পবিত্র ভূমি বা দার-উল-ইসলাম-এ পরিণত করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছিল।
3.   উভয় আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল হিন্দু জমিদার এবং ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী।
4.   উভয় আন্দোলনেই সাধারণ মানুষ, কৃষক ও শ্রমজীবীদের সংঘবদ্ধ করার জন্য ইসলামকে ব্যবহার করা হয়েছিল।
ফরাজি ও ওয়াহাবি আন্দোলনের পারস্পরিক বৈসাদৃশ্য-
ফরাজি ও ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল মোটামুটি সমসাময়িক, উভয় আন্দোলনেরই সময়কাল ছিল ঊনবিংশ শতাব্দী। এ ছাড়া হিন্দু জমিদার ও শাসক বিরোধী ধর্মীয় আন্দোলন রূপে পরিচালিত হওয়ার কারণে উভয় আন্দোলনের মধ্যেই কিছু সাধারণ সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এদের পারস্পরিক বৈসাদৃশ্যগুলি বিশেষভাবে লক্ষণীয়
1.   বিস্তৃতির দিক থেকে ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল ফরাজি আন্দোলনের তুলনায় ব্যাপকতর। যদিও বাংলায় এর কেন্দ্রস্থল ছিল বারাসাত ও তার সংলগ্ন অঞল কিন্তু এর উৎপত্তি ঘটেছিল আরব দেশে এবং বাংলার বাইরেও উত্তর ভারতে এই আন্দোলনের অস্তিত্ব লক্ষ করা গিয়েছিল। অপরদিকে ফরাজি আন্দোলন ছিল মূলত পূর্ববঙ্গ বা বর্তমান বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
2.   উভয় আন্দোলনের লক্ষ্য ইসলামের শুদ্ধিকরণ হলেও ফরাজি নেতা হাজি শরিয়উল্লাহ কোরানে নেই এমন যাবতীয় উৎসব-অনুষ্ঠান বর্জন করার নির্দেশ। দিয়েছিলেন, কিন্তু ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ তেমন কোনো নির্দেশ দেননি।
3.   ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় উদ্দেশ্যে পরিচালিত এবং এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ইংরেজ রাজত্বের বিকল্প একটি মুসলিম রাজ্যগঠন। অপরপক্ষে ফরাজি আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল কৃষকদের স্বার্থরক্ষা, ফলে এই আন্দোলন পরিণত হয়েছিল একটি কৃষক বিদ্রোহে।
4.   ফরাজি আন্দোলনের কার্যকলাপের মধ্যে সাম্যবাদ ও প্রজাতন্ত্রের ধারণার অস্তিত্ব ছিল যা ওয়াহাবি আন্দোলনে দেখা যায়নি।
5.   1831 খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক কর্তৃক তিতুমিরের বারাসাত বিদ্রোহ দমনের মাধ্যমে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের অবসান ঘটেছিল। অপরপক্ষে, দুদু মিঞার উত্তরাধিকারীগণ ধর্মসংস্কারে মনোনিবেশ করায় ফরাজি। | আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।
উপসংহারঃ-সুতরাং, বিস্তৃতি ও লক্ষ্যের দিক থেকে ফরাজি আন্দোলনের ব্যাপকতা ছিল ওয়াহাবি আন্দোলনের তুলনায় কম, কিন্তু ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল ফরাজি আন্দোলনের তুলনায় অধিক মাত্রায় সাম্প্রদায়িক। কিন্তু উভয় আন্দোলনই বাংলার নিম্নবর্গের মানুষের মর্যাদা ও স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যদিও তা একইসঙ্গে মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদকে প্রশয় দিয়েছিল।

7.সাঁওতাল বিদ্রোহ সম্পর্কে যা জান লেখঃ-
ভুমিকাঃ- সাঁওতালরা ছিল বীরভূম, মানভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদের প্রাচীন অধীবাসি। এরা ছিল কঠোর পরিশ্রমী ও শান্তিপ্রিয়, বিনিময় প্রথা ভিত্তিক কৃষিজিবী জনগোষ্ঠী। ভাগলপুরে রাজমহল পাহাড়ের প্রান্তদেশে বনভূমি পরিষ্কার করে বসবাস করত। এটি ‘দামিন-ই-কোহ’ নামে পরিচিত যার অর্থ হল ‘পাহাড়ের প্রান্তদেশ’। ইংরেজদের চাপে তারা 1811-1881 এর মধ্যে সাতবার বিদ্রোহ করে, এর মধ্যে 1755-56 এর বিদ্রোহ ছিল সবথেকে ব্যাপক ,ভয়ঙ্কর ও গুরুতর।
বিদ্রোহের কারণঃ- এই অঞ্চলেও তারা জমিদার ও কর্মচারীদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি তাই তারা শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ ঘোষন করেন। নিম্নে বিদ্রোহের কারনগুলি উল্লেখ করা হল—
4.   খাজনা বৃদ্ধিঃ- বাংলা,বিহার, উড়িষ্যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হলে তাদের তৈরী করা পাথুরে জমি থেকে আবাদি জমিতএ নতুন ভুমিব্যাবস্থায় খাজনা ধার্য করা হয়। বিনা খাজনায় অভ্যস্ত সাঁওতালদের খাজন ক্রমে বৃদ্ধি পেলে তাদের মধ্যে তীব্র বিক্ষভের সৃষ্টি হয়।
5.   মহাজনদের শোষণঃ- নতুন ভুমিরাজস্বে নগদ অর্থে খাজনা দিতে হত। সাঁওতালরা নগদ অর্থের জন্য মহাজনদের কাছে ঋণ নিতে বাধ্য হত যার সুদ প্রায় 50%-500% ছিল।একবার ঋণ নিলে তারা বেরিয়ে আসতে পারতনা তাই মহাজনরা তাদের উপর নির্মম অত্যাচার চালাত।সর্বস্ব হারানোর পরেও নিজেকে দাসে পরিনত হতে হত।
6.   বহিরাগত ব্যাবসায়ীদের কারচুপিঃ- বিদেশি ব্যাবসায়ীরা দোকান খুললে ফসলের বিনিময়ে চড়া দামে দ্রব্য কিনতে গিয়ে সর্বশান্ত হত। ব্যাবসায়ীরা ভুয়া বাটখারায় (কেনারাম,বেচারাম) কেনা বেচা করে ঠকাতো। তাদের এই কারচুপি জানতে পারলে সাঁওতালরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
7.   কর্মচারী ও ঠিকাদারের শোষণঃ- 1853 সালে লর্ড ডালহৌসি রেলপথের কাজ শুরু করলে কিছু ইংরেজ কর্মচারী ও ঠিকাদারদের স্বল্প মজুরিতে শ্রমিক নিয়োগ করত। তাঁদের হাঁস,মুরুগি,ছাগল কেড়ে নিত,এমনকি সাঁওতাল মেয়েদের সম্মানে হাত দিতেও তারা কুন্ঠাবোধ করেনি।
8.   অন্যান্যঃ- (a) সাঁওতালদের নিজস্ব আইনে তারা হস্তক্ষেপ করে। ছোটলাট ফ্রেডারিক হ্যালিডের নির্দেশে তাদের দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনে আনা হয়। তারা সুবিচার পেতনা। (b) খ্রীষ্ঠান মিশনারিরা তাঁদের ধর্মান্তরিত করত
বিদ্রোহের সূচনাঃ- এইসব অত্যাচারের প্রতিবাদে তারা স্থানীয় কতৃপক্ষের কাছে আবেদনে সমস্যা মিটবেনা বুঝতে পারে তাই তারা 1855 সালে 30 জুন ভাগনাডিহির মাঠে সিধু ও কানু নামে দুই ভাই-এর নেতৃত্বে 10 হাজার সাঁওতাল ‘স্বাধীন সাঁওতার রাজ্য’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করে। 9 ই জুলাই বিদ্রোহ ঘোষণা করে অনেক মহাজন ও জমিদারের হত্যা করে। তারা পাকুড়ের রাজবাড়ি দখল করে,নীলকুঠি ও রেল বাংলো ধ্বংস করে। 10-50 হাজার বিদ্রোহি বিদ্রোহে যোগদান করেন।চাঁদ, ভৈরব,বীরসিংহ চিল এই বিদ্রোহের অন্যতম নেতা
বিদ্রোহের দমনঃ- আধুনিক অস্ত্রশাস্ত্রে সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে লাঠি, ট্যাঙ্গি, বল্লম, তীরধনুক নিয়ে সাঁওতালরা তাদের কাছে পরাজিত হয়। 23 হাজার বিদ্রোহীকে হত্যা করে সিধু কানু সহ অন্যান্য নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। এইভাবে 1856 সালে ইংরেজরা নির্মমভাবে এই বিদ্রোহ দমন করেছিল।
বিদ্রোহের বৈশিষ্টঃ-  এই বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
             i.  এটি ছিল একটি গন বিদ্রোহ। এতে ডোম, চামার, ছুতর, হিন্দু, মুসলিম, কামার সবাই যোগদান করেছিল।
             ii.  সাঁওতাল বিদ্রোহ শুধু উপজাতি বিদ্রোহ ছিলনা এটি ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে কৃষক ও শ্রমজীবিদের সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদ
            iii.  এতে যুবকদের পাশাপাশি কিশোর, বৃদ্ধ, নারীরাও সক্রিয় ভুমিকা পালন করেছিলসন্তান কোলে নিয়ে নারীরা কারাবরণ করত।
ফলাফল বা গুরুত্বঃ- এই বিদ্রোহের ফলে –
             iv.  সাঁওতাল অধুষ্যিত এলাকা নিয়ে ‘সাঁওতাল পরগনা’ জেলা গঠন করা হয়।
              v.  সাঁওতালদের পৃথক উপজাতি বলে ঘোষণা করা হয় এবং বলা হয় ব্রিটিশ আইন এখানে কার্যকর হবেনা
             vi.  খ্রীষ্টান মিশনারি ছাড়া সবার প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়
উপসংহারঃ- এই বিদ্রোহ ছিল একটি তীব্র ব্রিটিশ বিরুদ্ধ প্রতিবাদ নরহরি কবিরাজের মতে এই বিদ্রোহ ছিল সকল সম্প্রদায়ের দরদ্র মানুষদের মুক্তি যুদ্ধ। কালীকঙ্কর বলেন- ‘’বাংলা, বিহারের ইতিহাসে এই বিদ্রোহ নবযুগের সূচনা করে’’। ডঃ দত্তের মতে -‘’এটিকে গুরুত্বহীন আঞ্চলিক বিদ্রোহ বলা অনুচিত’’।রমেশচন্দ্রের মতে- ‘’এই সুকঠিন বিদ্রোহকে স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা দেওয়া উচিত’’। সুপ্রকাশ রায় বলেন- ‘’সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল ভারতের প্রথম মুক্তি সংগ্রাম’’



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top