Workers and peasants party সম্পর্কে টীকা লিখ ।
Workers and peasants party সম্পর্কে টীকা লিখ । |
পেজেন্টস
পার্টির বাংলা
শাখাঃ- কাজি নজরুল ইসলাম, হেমন্ত কুমার সরকার, কুতুবউদ্দিন আহমেদ প্রমুখের উদ্যোগে 1925 খ্রিস্টাব্দে বাংলায় কংগ্রেস দলের মধ্যে ‘লেবার স্বরাজ পার্টি অব দ্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস নামে একটি দল প্রতিষ্ঠিত হয়। 1926 খ্রিস্টাব্দে এই দলের নাম হল ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি অব বেঙ্গল। বাংলার অনুকরণে বিভিন্ন প্রদেশে শীঘ্রই এই পার্টির শাখা গড়ে ওঠে। এই শাখাগুলি ঐক্যবদ্ধ হয়ে 1928 খ্রিস্টাব্দে অল ইন্ডিয়া ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। দলের সাধারণ সম্পাদক হন আর এস নিম্বকার।
উদ্দেশ্যঃ-
ওয়ার্কার্স
অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ছিল—
a.
শ্রমিকদের কাজের সময়সীমা কমানো
b.
সর্বনিম্ন মজুরির হার নির্ধারণ
c.
জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ প্রভৃতি
কার্যকলাপঃ- এই দল শ্রমিকদের মধ্যে প্রচার করতে থাকে যে, শ্রমিকরা অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বাধীনতা না পেলে রাজনৈতিক দিক থেকে স্বাধীনতার কোনো মূল্যই থাকবে না। পেজেন্টস পার্টির নেতারা রাজনৈতিক আন্দোলন ও শ্রেণি সংগ্রাম সম্পর্কে শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে থাকেন। শ্রমজীবীরা বুঝতে পারে তারা আলাদা একটা সামাজিক শ্রেণি। তাদের মধ্যে এক ঐক্যভাব গড়ে ওঠে। শোষকশ্রেণিকে তারা চিনতে পারে। নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য তারা যৌথভাবে আলোচনা শুরু করে। শিল্পাঞ্চলে ক্রমশ তারা সংগঠিত হয়ে ওঠে।
মুখপত্রঃ- বিভিন্ন প্রদেশে এই পার্টির মুখপত্র প্রকাশের মাধ্যমে শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক প্রচার চলতে থাকে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘লাঙল’, ‘গণবাণী’, ‘শ্রমিক’, ‘সোশ্যালিস্ট’ ‘কীর্তি', ‘লেবার-কিষাণ-গেজেট’ প্রভৃতি।
আন্দোলনঃ- এই দলের পরিচালনায় বোম্বাইয়ে রেল, ছাপাখানা, পৌরসভা, বন্দর প্রভৃতির শ্রমিকরা শক্তিশালী সরকার-বিরোধী আন্দোলন করে।
মিরাট
ষড়যন্ত্র মামলাঃ- এই দলের আন্দোলনে আতঙ্কিত হয়ে সরকার এই দলের বহু নেতাকে গ্রেফতার করে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় (1929 খ্রি.) অভিযুক্ত করলে তাদের আন্দোলনের গতি দুর্বল হয়ে যায়।
মূল্যায়নঃ- ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে ভারতের শ্রমজীবীদের মুক্তি আন্দোলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই সংগঠন গঠনমূলক ভূমিকা পালন করলেও এই সংগঠন ছিল শহরকেন্দ্রিক, তাই শহরের শিল্পশ্রমিকেরা এর আওতায় এসেছিল। গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে তারা নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তুলতে না পারায় কৃষকেরা সংগঠিত হতে পারেনি। কিন্তু এই সংগঠনের হাত ধরেই কমিউনিস্ট পার্টি তার সংগঠন বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হয়।
টীকা লেখ- তেভাগা আন্দোলন।
ভূমিকাঃ- ভারতের স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে বাংলার শাসিত, শোষিত, নিপীড়িত, দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত কৃষক সম্প্রদায় শোষক শ্রেণির অর্থাৎ জমিদার, জোতদার ও সরকারের বিরুদ্ধে যে প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে তা ‘তেভাগা আন্দোলন’ নামে পরিচিত। 1946 খ্রিস্টাব্দের শেষ। দিকে দিনাজপুর জেলায় এর সূত্রপাত ঘটলেও, অচিরেই তা সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
আন্দোলনের কারণঃ- বিভিন্ন কারণে তেভাগা আন্দোলন শুরু হয়-
1. জমিদার ও জোতদারদের শোষণ ও অত্যাচার কৃষকদের অসহিষ্ণু করে তোলে
2. 1936 খ্রিস্টাব্দে ‘সারা ভারত কৃষক সভা’ প্রতিষ্ঠা, 1937 খ্রিস্টাব্দে ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক প্রজা পার্টির সরকার গঠন কৃষকদের নিজ দাবি আদায়ে উৎসাহিত করে
3. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজনিত কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি কৃষকদের সংকট ঘনীভূত করে ইত্যাদি
4. 1943 খ্রিস্টাব্দে বাংলা সন 1350 বঙ্গাব্দে বাংলায় এক ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এতে প্রায় লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়,
5. সর্বোপরি, কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ কৃষকদের স্বার্থে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করলে আন্দোলন ভয়ংকর হয়ে ওঠে।
কৃষকদের দাবিঃ- তেভাগার কৃষক আন্দোলনকারীদের প্রধান দাবি ছিল—
1. উৎপন্ন ফসলের তিনভাগের দু'ভাগ কৃষকদের দিতে হবে
2. জমিতে চাষিকে দখলি স্বত্ব দিতে হবে
3. জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ঘটাতে হবে
4. ভূমিরাজস্বের পরিমাণ হ্রাস করতে হবে ইত্যাদি।
স্লোগানঃ- তাদের স্লোগান ছিল ‘আধি নয়, তেভাগা চাই’, ‘জমিদারি প্রথা ধবংস হোক’, ‘লাঙল যার জমি তার’ ইত্যাদি।
বিস্তারঃ- দিনাজপুর জেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামে এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। অচিরেই জলপাইগুড়ি মেদিনীপুর, চব্বিশ পরগনা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি 19 টি জেলায় এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
নেতৃত্বঃ- তেভাগা আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দের
অন্যতমরা ছিলেন—চারু মজুমদার, গুরুদাস তালুকদার, সমর গাঙ্গুলী, ভবাণী সেন, বুড়িমা,
অবণী রায় প্রমুখ।
গুরুত্বঃ- জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে, হিন্দু-মুসলমান, পুরুষ-নারী নির্বিশেষে সকলে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। সরকার চরম দমননীতির মাধ্যমে আন্দোলন দমন করে। অবশেষে 1949 খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এক অর্ডিন্যান্স জারি করে তেভাগার দাবি স্বীকার করে নেয়।
টীকা লেখঃ শ্রমিক
আন্দোলন ও AITUC
অথবা নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন
কংগ্রেস সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।
শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে 1920
খ্রিস্টাব্দের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের
প্রতিষ্ঠা(AITUC)। 1920
খ্রিস্টাব্দের 30 অক্টোবর বোম্বাই শহরে লালা লাজপৎ রায়ের
সভাপতিত্বে এর প্রথম অধিবেশন বসে। দেওয়ান চমনলাল ছিলেন AITUC-এর সাধারণ
সম্পাদক।
AITUC নেতৃত্ব:
লালা লাজপৎ রায় ছাড়াও অন্যান্য যেসব বিশিষ্ট জাতীয় স্তরের নেতা এই অধিবেশনে যোগ
দিয়েছিলেন, তাদের
মধ্যে মোতিলাল নেহরু,
বল্লভভাই প্যাটেল,
অ্যানি বেসান্ত, মহাম্মদ
আলি জিন্নাহ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। অনুপস্থিতির তালিকায় ছিলেন গান্ধিজি
নিজেই। এই অধিবেশন চলেছিল 2 নভেম্বর পর্যন্ত।
কর্মসূচি:- এই সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে লালা লাজপত রায় ব্রিটিশের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণিকে আরও ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান এবং তাদের
স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। পুঁজিবাদ ও
উপনিবেশবাদের বিরোধিতা সমালোচনা করে এবং
একই সঙ্গে তিনি ভারতের পুঁজিপতি ও মালিকশ্রেণিকেও সাবধান করে দেন । তিনি রুশ বিপ্লবকে অভিনন্দন জানান এবং শ্রমিকদের সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কথা বলেন।
সীমাবদ্ধতা :- AITUC গঠিত হলে শ্রমিক আন্দোলন জোরদার হলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতাও লক্ষ্য করা যায়, যেমন—(i) এর নেতৃবৃন্দ পূর্ণস্বরাজের জন্য বৈপ্লবিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেননি।
(ii) প্রথমদিকে জাতীয় কংগ্রেসের বেশ কিছু নেতা এর সঙ্গে যুক্ত থাকলেও জাতীয় কংগ্রেস একে স্বীকৃতি দেয়নি। কারণ কংগ্রেস শ্রমিক আন্দোলনের স্বাধীন সত্তার বিরোধী ছিল।
(ii) আবার, এতে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বও প্রতিষ্ঠিত হয়নি ইত্যাদি।
গুরুত্ব:- ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে AITUC-এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এর মাধ্যমেই শ্রমিকদের দাবীদাওয়া, উদ্যোগ, বিক্ষোভ একটি নির্দিষ্ট পথে চালিত হয় এবং তা এক সর্বভারতীয় রূপলাভ করে।
টীকা লেখ মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা।
অথবা মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা (1929) কী? এই প্রেক্ষাপট কী ছিল? এই মামলার পরিণতি কী হয়েছিল?
ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের প্রভাব বৃদ্ধি পেলে ব্রিটিশ সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এইরূপ পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে কঠোর দমননীতি গ্রহণ করেছিল। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা (1929) হল এরকমই এক দমননীতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
A.
শ্রমিক-মালিক
বিরোধ:- ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে ভারতে শিল্পায়ন শুরু হলে শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব হয়।
বিংশ শতকের প্রথম দিকে মালিক শ্রেণির শোষণ ও অত্যাচারে শ্রমিক-মালিক সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
শ্রমিক শ্রেণির অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে কমিউনিস্টরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন জোরদার করে তুলে ব্রিটিশ সরকার চিন্তায় পড়ে যায়।
B.
পূর্ণ
স্বাধীনতার
দাবি:-1928 সালে জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে প্রায় পঁচিশ হাজার শ্রমিক যোগ দেয়।
এখানে তারা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তোলে যা ব্রিটিশের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
C.
হুইটলি
কমিশন নিয়োগ:- ক্রমাগত শ্রমিক অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার 1929 সালে হুইটলি কমিশন নিয়োগ করে।
কিন্তু শ্রমিক শ্রেণি এই কমিশন বর্জন করে।
D.
শ্রমিক
বিরোধী বিল:- লর্ড আরউইন তাঁর জরুরি ক্ষমতা প্রয়োগ করে 'শিল্পবিরোধ
বিল' (Trade Disputes Bill) ও 'জননিরাপত্তা
বিল' (Public State Bill) পাশ করে।
এই আইনের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টরা সোচ্চার হলে সরকার আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
এই পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট পার্টির কার্যকলাপ ও তাদের নেতৃত্বে শ্রমিক আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার 1929 সালে 33 জন কমিউনিস্ট শ্রমিক নেতাকে গ্রেফতার করে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। এই মামলাই 'মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা' নামে পরিচিত।
a.
1933
সালে এই মামলার রায়ে কমিউনিস্ট পার্টির যাবতীয় প্রচারকার্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
b.
এই মামলার ফলে বিভিন্ন কমিউনিস্ট নেতার দীর্ঘ মেয়াদি কারাদন্ড হয়।
c.
ভারতে কমিউনিস্ট আদর্শের প্রসার রোধ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার কঠোর দমন নীতি গ্রহণ করে।
d.
1934
সালে শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব লক্ষ্য করে সরকার কমিউনিস্ট পার্টি ও তার সকল শাখা সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
এই দমন-পীড়ন সত্ত্বেও ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির অবদান নির্ণয়ে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার গুরুত্ব অপরিসীম।
a. এই মামলায় গান্ধিজি কমিউনিস্ট নেতাদের সমর্থন করলে কমিউনিস্টদের উৎসাহ বাড়ে।
b. জেলে বন্দি বামপন্থী নেতাদের আদর্শ ও বক্তব্য সংবাদপত্রের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে পৌঁছালে ভারতে সমাজতন্ত্রের আদর্শ দ্রুত প্রসার লাভ করে।
c. সরকার 1934 সালে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ করলে এই পার্টির প্রভাব শ্রমিক শ্রেনির ওপর বেড়ে যায়।
d. এর ফলে স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
মানবেন্দ্র রায় ওরফে এম.এন রায় কি জন্য বিখ্যাত?
ভূমিকা
:- ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, যিনি এম. এন. রায় (মানবেন্দ্রনাথ রায়) নামেই বেশি পরিচিত।
বিপ্লবী
আন্দোলনে অংশগ্রহণ:- বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটে পড়াকালীনই ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনে যোগদানকারী মানবেন্দ্রনাথ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল বাঘাযতীনের নির্দেশে জার্মানির কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রামের উদ্দেশ্য মানবেন্দ্রনাথ রায় বাটাভিয়ায় যান। সেখান থেকে আমেরিকা হয়ে মেক্সিকোতে পৌছান এবং সেখানে মিখাইল বোরোদিন নামে এক বলশেভিক নেতার সংস্পর্শে আসেন ও মার্কসবাদ দীক্ষা নেন।
কমিউনিস্ট
পার্টি প্রতিষ্ঠা
:-1920 খ্রিস্টাব্দে লেনিনের আমন্ত্রণে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সম্মেলনে ভারতের পক্ষ থেকে যোগ দেন এবং এখানেই 1920 খ্রিস্টাব্দের 17 অক্টোবর এম. এন. রায় অবনী মুখার্জি প্রমুখ নেতাদের নিয়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলেন। যা পরের বছরই কমিনটার্ন-এর স্বীকৃতি লাভ করে।
ভারতে
কমিউনিস্ট আন্দোলনে
ভূমিকা:- ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশের পূর্বেই কিছু বিপ্লবী নিজ প্রচেষ্টায় কমিউনিস্ট গোষ্ঠী
গঠনের চেষ্টা করলে এম. এন, রায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগের স্থাপনের জন্য নলিনী গুপ্ত ও শওকত উসমানীকে ভারতে পাঠান।
কমিউনিস্ট
আন্দোলনে পরিচালনায়
রণকৌশলঃ- ভারতে কমিউনিস্ট দলকে শক্ত ভীতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি দ্বিস্তর আন্দোলনের কথা তুলে ধরেন—
I.
জাতীয় আন্দোলনে যোগদানের মাধ্যমে আইনগত ও বৈধভাবে আন্দোলন করা এবং
II.
গোপনে শ্রমিক-কৃষক সংগঠন দ্বারা দলের নিজস্ব ভিত্তি শক্ত করা।
মূল্যায়ন
:- মানবেন্দ্রনাথ রায়ের উদ্যোগেই ভারতের নানা প্রান্তে সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী মানুষজনের সহযোগিতায় কমিউনিস্ট পার্টির শাখা গড়ে ওঠে, যার চূড়ান্ত | পরিণতি 1925 খ্রিস্টাব্দে কানপুরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা। এই কমিউনিস্ট নেতা 1954 খ্রিস্টাব্দের 25 জানুয়ারি পরলোক গমন করেন।
কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের উদ্ভব কীভাবে হয়?
অথবা, টীকা লেখ : কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল।
ভূমিকা:- বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার ব্যাপক প্রসার ঘটে। এরই ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল। কংগ্রেসের মূল ধারার পাশাপাশি বামপন্থী ধারারও প্রসার ঘটতে থাকে।
প্রতিষ্ঠা :-1934 খ্রিস্টাব্দের 23 অক্টোবর বোম্বাই-এ কংগ্রেস স্যোশালিস্ট পার্টি বা কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দলের প্রথম সভাপতি ছিলেন আচার্য নরেন্দ্র দেব, এবং প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ।
কারণঃ- এই দল প্রতিষ্ঠার পিছনে কতকগুলি কারণ ছিল যেমন—
i. আইন অমান্য আন্দোলনের ব্যর্থতা
ii. শ্রমিক-কৃষকদের দুর্দশায় কংগেসের উদাসীনতা,
iii. কংগ্রেসের দুই তরুণ নেতা জওহরলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্রের প্রভাব,
iv. রুশ বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রভাব,
v. কমিউনিস্টদের কার্যকলাপের প্রভাব,
vi. সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে গান্ধিজি ও তার অনুগামীদের বিরূপ মন্তব্য,
vii. গান্ধিজির আন্দোলন পদ্ধতি বিষয়ে বামপন্থীদের বিরূপ মনোভাব,
viii. কংগ্রেসের বামগোষ্ঠীর শক্তিবৃদ্ধি,
ix. সর্বোপরি, ব্রিটিশ সরকারের চরম দমনপীড়ন নীতি প্রভৃতি ছিল উল্লেখযোগ্য।
নেতৃবৃন্দঃ- আচার্য নরেন্দ্র দেব, জয়প্রকাশ নারায়ণ, রামমনোহর লোহিয়া, অচ্যুত পট্টবর্ধন, ইউসুফ মেহর আলি, অরুনা আসফ আলি, মিনু মাসিনি প্রমুখ ছিলেন এই দলের প্রধান নেতা।
কর্মসূচিঃ- এই দলের প্রধান কর্মসূচি ছিল-
i. কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী শক্তিকে সুসংহত করা,
ii. ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ঐতিহ্যকে সামনে রেখে স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনা করা
iii. জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী ও শ্রমিক বিরোধী আইন বাতিল করা,
iv. দেশের সকল উপনিবেশ-বিরোধী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা,
v. শিক্ষার বিস্তার ও বেকারত্ব দূর করা,
vi. দেশিয় রাজতন্ত্র, জমিদারি ও তালুকদারী প্রথার অবসান ঘটানো,
vii. কৃষকদের মধ্যে জমি বণ্টন, কৃষি ঋণ মকুব, ন্যায্য মজুরি, শিল্প-বাণিজ্যের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ছিল এর কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত।
গুরুত্ব:- বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কংগ্রেস সমাজতন্ত্রীদলের গুরুত্ব অপরিসীম।
i. এই দলের প্রভাবে 1937 খ্রিস্টাব্দে প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে কংগ্রেস সাফল্য লাভ কর।
ii. এই দলের চাপে কংগ্রেস কৃষি ও ভূমি সংস্কারে যত্নবান হয়,
iii. ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা গ্রেপ্তার হলে গোপনে সমাজতন্ত্রীরাই আন্দোলন পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে ইত্যাদি।
1.
অসহযোগ
আন্দোলনের সময় কৃষক আন্দোলন গুলি পরিচয় দাও
ভুমিকাঃ-
1920-1922
খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেবলমাত্র
শহরের মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীরা নয়; শ্রমিক, কৃষক, মজুর, নারী-পুরুষ সমাজের সর্বস্তরের
মানুষের অংশগ্রহণে এই আন্দোলন যথার্থ গণআন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। এই আন্দোলনের
পরিধি গ্রামাঞ্চলেও ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। যার মূল ভিত্তি
ছিল কৃষক ও উপজাতি সম্প্রদায়। এই আন্দোলনের দ্বিমুখী চরিত্র লক্ষ্য করা
যায়। কোথাও
কোথাও জাতীয় কংগ্রেস এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল আবার অন্যত্র আন্দোলন গুলি ছিল
স্বয়ংক্রিয়। ভারতবর্ষের
বিভিন্ন অঞ্চলে যেমন বাংলা, বিহার, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ প্রভুতি
স্থানে গ্রামীণ কৃষক আন্দোলনের প্রসার ঘটেছিল।
বাংলাঃ- অসহযোগ
আন্দোলনের সময় বাংলার কৃষকরা অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। প্রথম
বিশ্বযুদ্ধ জনিতকরভার ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং জমিদারের শোষণ বাংলায় কৃষকদের
সর্বনাশের শেষ সীমায় পৌঁছে দেয়। 1921 খ্রিস্টাব্দে বীরেন্দ্রনাথ শাসমল এর
নেতৃত্বে মেদিনীপুরের কাঁথি ও তমলুক মহকুমা ইউনিয়নবোর্ড বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে
ধনী দরিদ্র নারী পুরুষ নির্বিশেষে এই মহাকুমায় আপামর জনসাধারণ এই আন্দোলনে
অংশগ্রহণ করে।
আন্দোলনের চাপে সরকার নতি স্বীকারে বাধ্য হয়। এছাড়াও
পাবনা,বাগুড়া বীরভূম-এ জমি জরিপ করে খাজনা নির্ধারনের কাজে স্থানীয়রা কৃষকেরা
বাধা দেয় এবং কুমিল্লা, রাশাহী, রংপুর, দিনাজপুরের কৃষকরা অসহযোগ আন্দোলনে যোগ
দেয়।
গুজরাট : গান্ধিজির আঞ্চলিক আন্দোলনে সত্যাগ্রহ
আদর্শের পরীক্ষানিরীক্ষার ক্ষেত্র ছিল গুজরাটের খেদা জেলা। সত্যাগ্রহ আদর্শ তিনি।
পুনরায় বারদোলিতে প্রয়োগ করেন। বারদোলিতে 1926-27 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ
রাজস্বের পরিমান অত্যাধিক পরিমাণে বৃদ্ধি করা হয়েছিল।এছাড়াও ছিল উজালি পরাজ কর্তৃক কালি পরাজ দের উপর অত্যাচার। এখানকার পাতিদার এবং কালিপরাজ শ্রেণির কৃষকরা মিলিত হয় এবং তারা
কংগ্রেস নেতা সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল কে সেখানে আসার জন্য অনুরোধ জানান এবং
আন্দোলন শুরু করে সরকারকে কোনরকম কর না দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।সরকার আন্দোলনরত চাষীদের গরু-বাছুর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত এবং
নানারকম নির্যাতন করলেও আন্দোলন থামেনি এবং শেষ পর্যন্ত 1929 খ্রিস্টাব্দে 16
জুলাই সরকার খাজনা বৃদ্ধি স্থগিত রাখার ঘোষণা করে।
উত্তরপ্রদেশ : উত্তরপ্রদেশের প্রতাপগড়, ফৈজাবাদ ও রায়বেরেলিতে বাবা রামচন্দ্রের নেতৃত্বে কিষান আন্দোলন এবং ‘ খাজনা বন্ধ’ আন্দোলন শুরু হয়। উত্তরপ্রদেশের কিষানদের বেদখলি, বেগারি প্রথা ও বেআইনি বাড়তি খাজনার বিরুদ্ধে অসন্তোষ ছিল। এ বিষয়ে কুৰ্মী সম্প্রদায়ের কিষানরাই ছিল বেশি নির্যাতিত। বাবা রামচন্দ্র তাই ‘কুমী কিষান সভা’ গড়ে তোলেন। পুলিশ বাবা রামচন্দ্রকে গ্রেফতার করলে, অহিংসভাবে থানা ঘেরাও করা হয় এবং বাবা রামচন্দ্র মুক্তি পান। উত্তরপ্রদেশ কিষান সভা নরমপন্থী নীতি গ্রহণ করলে নেহরু ও রামচন্দ্র সংঘবদ্ধভাবে ‘অযোধ্যা কিষান সভা’ (1920) তৈরি করেন।কিন্তু অচিরেই এ আন্দোলন হিংসাত্মক হয়ে উঠলে কংগ্রেসের নেতৃত্ববৃন্দ এ আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ান। এর ফলে সরকার নিষ্ঠুর দমননীতি অবলম্বন করে আন্দোলন ভেঙ্গে দেয়। যাইহোক 1921 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ অযোধ্যা খাজনা আইন পাস করে সরকার কৃষকদের কিছুটা সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করে
১৯২১ খ্রিস্টাব্দের শেষ এবং ১৯২২-এর সূচনায় সামন্ততান্ত্রিক অনাচারের বিরুদ্ধে যুক্তপ্রদেশের হরদৈ,
বারাবাঁকি, সীতাপুর, বারাইচ
প্রভৃতি অঞ্চলে এক কৃষক বিদ্রোহ ঘটে। এই
বিদ্রোহ ‘একা’ বা ‘একতা’ বিদ্রোহ
বা আন্দোলন নামে খ্যাত। আন্দোলন চলাকালে যেকোনো অবস্থায় কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ থাকার
শপথ নেন—তাই
এই আন্দোলনের নাম
‘একা’ বা ‘একতা’ আন্দোলন।
আন্দোলনের সূচনা-পর্বে কংগ্রেসি নেতৃবৃন্দ এর সঙ্গে যুক্ত
থাকলেও মাদারী পাশী নামে অনুন্নত সম্প্রদায়ের এক নেতাই ছিলেন এই আন্দোলনের মূল
শক্তি। তার আহ্বানে অনুন্নত সম্প্রদায়ের কৃষকরা দলে দলে এই আন্দোলনে
ঝাপিয়ে পড়ে। মন্ত্রপাঠ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কষকরা শপথ নিত যে, নির্দিষ্ট
সময়ে নির্ধারিত খাজনা ছাড়া তারা বেশি কিছু দেবে না, জমি
থেকে উচ্ছেদ করলেও তারা জমি ছাড়বে। না রসিদ ছাড়া খাজনা দেবে না, খাজনা
দেবে নগদ টাকায়—শস্যের
মাধ্যমে নয়, জমিদারের
জমিতে বেগার খাটবে না,
ইত্যাদি ক্রমে এই আন্দোলন কংগ্রেস নেতাদের
হাত থেকে বেরিয়ে যায় এবং তা হিংসাশ্রয়ী হয়ে ওঠে। জমিদার ও তালুকদারদের ঘর-বাড়ি ও খামার আক্রান্ত হয় এবং কুমায়ুন অঞ্চলের হাজার হাজার
মাইল সংরক্ষিত অরণ্যে অগ্নিসংযোগ করা হয়। আসরফ সিদ্দিকির মতে, যুক্তপ্রদেশে
সামাজিক দস্যুতা’
(Social bandity) শুরু হয়। প্রচণ্ড নিষ্ঠুরতার
মাধ্যমে এই আন্দোলন দমন করা হয়। মাদারী পাশীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বিহার : বিহারের দ্বারভাঙা, মজফফরপুর, ভাগলপুর, পূর্ণিয়া প্রভৃতি অঞলে প্রবল কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে। চড়া
ভূমিরাজস্ব,
অতিরিক্ত কর এবং
মূল্যবৃদ্ধির জন্য কৃষকেরা অসন্তুষ্ট ছিল। এই পরিস্থিতিতে বিশুবরণ প্রসাদ
কৃষকদের সংগঠিত করেন। তিনি স্বামী বিদ্যানন্দ নামগ্রহণ করেন। তার আন্দোলনের
চাপে জমিদাররা নত হয়।
রাজস্থান : অসহযোগ আন্দোলনের সময়
রাজস্থানের কৃষকরাও বিদ্রোহে যোগদান করে। বিজয় সিং পথিক এবং মানিকলাল ভার্মা
রাজস্থানে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সূচনা করেন। মোতিলাল তেজওয়াত উদয়পুরের ভিল উপজাতিদের সংগঠিত করেন।
জয়নারায়ণ ব্যাস মাড়ওয়ার অঞলে খাজনা বন্ধের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
দক্ষিণ ভারত : অসহযোগ আন্দোলনের সময়কালে দক্ষিণ ভারতের কৃষকরাও বিদ্রোহী হয়ে
উঠেছিলেন। এই আন্দোলনের সময় কেরালার মালাবার অঞলের মোপলা বিদ্রোহ (1921খ্রীঃ) এক
ব্যাপক কৃষক বিদ্রোহরূপে দেখা দেয়। এই বিদ্রোহটি ছিল জমিদারদের অন্যায় শোষণের
প্রতিবাদস্বরূপ। তবে এই বিদ্রোহটি হিংসার রূপ ধারণ করলে অসহযোগ আন্দোলনের থেকে
বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত এই বিদ্রোহটি ব্যর্থ হয়। অন্ধ্রপ্রদেশে আল্লুরি
সীতারাম রাজু নেতৃত্বে আদিবাসী (রম্পা উপজতি)কৃষকরা মহাজনি শোষণের বিরুদ্ধে
বিদ্রোহ(1922-24 খ্রীঃ)করেছিলেন। প্রাথমিক পর্বে এই আন্দোলন
গণবিদ্রোহের আকার নিয়েছিল তবে রাজুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এই বিদ্রোহও গতিহারায়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে বিক্ষিপ্ত হলেও ভারতের বিভিন্ন
রাজ্যের কৃষক সম্প্রদায় এই
আন্দোলনে যোগদান করে। এক্ষেত্রে যতটা ব্রিটিশবিরোধী তার চেয়েও বেশি স্থানীয় জমিদার
বিরোধী মনোভাব কৃষকদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়।
মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে কংগ্রেস দল 1930 খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করে।
এই আন্দোলনে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের শ্রমিকরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
মহারাষ্ট্রে
ধর্মঘট:- মহারাষ্ট্রের শোলাপুর, নাগপুর ও বোম্বাই-এ ব্যাপক শ্রমিক ধর্মঘট হয়।
শোলাপুরে বস্ত্র-শ্রমিকদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে ক্ষিপ্ত শ্রমিকরা রেলস্টেশন, থানা, আদালত ও সরকারি দপ্তরে আক্রমণ চালায়।
বোম্বায়ে প্রায় 20 হাজার শ্রমিক স্বাধীনতার দাবি জানায়।
বোম্বায়েরর রেল-শ্রমিকরা রেললাইনে শুয়ে, রেল অবররোধ করে আইন অমান্য আন্দোলন চালায়।
বাংলায় ধর্মঘট:- কলকাতার বিভিন্ন চটকল, পরিবহণ ও শিল্পকারখানার শ্রমিকরা ধর্মঘট করে।
এ ছাড়া কুলটির লৌহ-ইস্পাত কারখানা, রানিগঞ্জের কয়লাখনি প্রভৃতি স্থানের শ্রমিকরাও ধর্মঘট করে।
অন্যান্য স্থানে
ধর্মঘট:- গুজরাটের ডান্ডি নামক স্থানে গান্ধিজির লবণ আইন অমান্য আন্দোলনে বহু শ্রমিক অংশ নেয়।
এছাড়া করাচি বন্দর, হীরাপুরে লৌহ-ইস্পাত কারখানা, আসামের ডিগবয় তৈলশোধনাগার, মাদ্রাজের শিল্পকারখানার শ্রমিকরাও ধর্মঘটে শামিল হয়।
কমিউনিস্ট পার্টির
ভুমিকা:- আইন অমান্য আন্দোলনের সময় শ্রমিকদের আন্দোলনে শামিল করার ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল|বিটিরণদিভে, সোমনাথ লাহিড়ী প্রমুখ কমিউনিস্ট নেতার নেতৃত্বে 1931খ্রিস্টাব্দে রেড ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়।
শ্রমিক ধর্মঘটে কমিউনিস্ট পার্টির ব্যাপক ভূমিকা থাকায় সরকার এই বছর কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
আন্দোলনের
গতি হ্রাস:- সরকারের কঠোর দমননীতি, কমিউনিস্টদের মধ্যে মতভেদ প্রভৃতির ফলে আইন অমান্য আন্দোলনের শেষদিকে শ্রমিক আন্দোলনের গতি দুর্বল হয়ে পড়ে।
ভূমিকাঃ- ভারত
ছাড়ো আন্দোলনের সময় বাংলা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত
হয়েছিল।
আন্দোলনের প্রসারঃ- গোটা
বাংলা জুড়ে ভারত ছাড়ো আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল। মেদিনীপুর, বীরভূম, দিনাজপুর, ফরিদপুরে
এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। বীরভূম ও দিনাজপুরের সাঁওতাল উপজাতি ও মুসলিম
কৃষিজীবীরা এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। মেদিনীপুরের তমলুকও কাঁথি মহকুমা এবং
দিনাজপুরের বালুরঘাটে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল।
কৃষক আন্দোলনের
চরিত্রঃ-
a.
চরিত্রগত দিক
থেকে এই আন্দোলনে বাংলার আদিবাসী সম্প্রদায়,
রাজবংশী ও নমঃশূ দ্ররা অংশ নিয়েছিল।
b.
এই আন্দোলনে
কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে যোগদান না করার নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও অনেকেই
অংশগ্রহণ করেছিল।
c.
পূর্ববঙ্গের
মুসলিম কৃষকদের অনেকেই এই আন্দোলনে অংশ নেয়নি।
d.
এই আন্দোলনে
বহুক্ষেত্রে উচ্চবর্ণের মানুষেরা কৃষকদের প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল।
আন্দোলনের তীব্রতা হ্রাসঃ-
ব্রিটিশ সরকারের তীব্র দমননীতির ফলে এই আন্দোলন, ধীরে ধীরে স্তিমিত
হয়ে আসে।
উপসংহারঃ-
মেদিনীপুরে জাতীয় সরকার গঠিত হলে তাতে বহু কৃষক অংশ নিয়েছিল। ভারত ছাড়ো
আন্দোলনের প্রসার বাংলায় কৃষক
আন্দোলনের গতি পরিবর্তন করে দিয়েছিল।
ভূমিকাঃ-
গান্ধিজির নেতৃত্বে এদেশে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে শ্রমিকেরাও তাতে প্রবল
উৎসাহের সঙ্গে অংশ নেয়। এই সময় বিভিন্ন
কলকারখানা, রেল
ও ডাক ব্যবস্থায় বহু সংখ্যায় ধর্মঘট ঘটেছিল।
শ্রমিক আন্দোলনঃ-
অসহযোগ আন্দোলনের সময় শ্রমিক আন্দোলন বড়ো আকার নিয়েছিল।1921
খ্রিস্টাব্দে 396টি
শ্রমিক ধর্মঘটে 6
লক্ষ শ্রমিক অংশ নেয়। 1920
খ্রিস্টাব্দে শুধু বাংলার পাটকলে 18479
জন শ্রমিক 137 ধর্মঘটে
অংশ নেয়।
শ্রমিক ধর্মঘট:- এ সময়
মার্টিন, জেকব
ও বার্ন কোম্পানিগুলিতে ধর্মঘট শুরু হয়েছিল। অসমের চা বাগানে এবং
পূর্ববঙ্গের সর্বত্র স্টিমার ধর্মঘট হয়েছিল।
ইংল্যান্ডের যুবরাজের আগমন:- 1921
খ্রিস্টাব্দের 17 নভেম্বর
প্রিন্স অফ ওয়েলস ভারতে এলে বোম্বাইয়ে ব্যাপক শ্রমিক ধর্মঘট শুরু হয়।
বোম্বাইয়ের পুলিশের গুলিতে 563
জন নিহত ও প্রায় 400
জন আহত হয়।
নেতৃত্ব:- স্বামী
দর্শনানন্দ ও স্বামী বিশ্বানন্দ রানিগঞ্জ ও ঝরিয়ার
কয়লাখনির শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। পূর্ববঙ্গের
স্টিমার ধর্মঘটে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত নেতৃত্ব দেন।
উপসংহারঃ-অসহযোগ
আন্দোলনের সময় শ্রমিকরা ভারতে তীব্রভাবে অংশ নিয়েছিল। এর পূর্বে এত শ্রমিক
ধর্মঘট আর দেখা যায়নি।
5.
ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলনের বর্ণনা দাও।
ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ভারতের বেশ কিছু অঞলে কৃষক আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল।
এ
মূল
কেন্দ্রঃ- ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে যে কৃষক আন্দোলন হয়েছিল তার মূলত চারটি কেন্দ্র লক্ষ করা যায়।
এগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হল-
i. বাংলা ও বাংলার মেদিনীপুর জেলার তমলুক অঞ্চলে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় বড়ো ধরনের কৃষক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়।
এখানকার ভগবানপুর, মহিষাদল, তমলুক, সুতাহাটা ও নন্দীগ্রামের কৃষিজীবী মানুষ আন্দোলনে শামিল হয়।
বহু জায়গার মানুষেরা খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়।
ii. ওড়িশা
অঞ্চল :- ওড়িশার কটক, কোলাপুর, তালচের প্রভৃতি অঞ্চলের কৃষকেরা খাজনা বন্ধ, থানা আক্রমণ, সংরক্ষিত অরণ্যে অনুপ্রবেশের মধ্য দিয়ে আন্দোলন জারি করে।
লক্ষ্মণ নায়েক ছিলেন এই অঞ্চলের আন্দোলনের নেতা।
iii. বিহার
ও যুক্তপ্রদেশ
অঞ্চল :- ভারত ছাড়ো আন্দোলনে বিহারের কৃষকেরা অংশ নিয়েছিল।
সুমিত সরকারের মতে, “উত্তর ও মধ্য বিহারের 10টি জেলায়, 80 শতাংশ থানা বেদখল হয়ে গিয়েছিল।‘’
যদিও বিহারের অন্যতম কৃষক নেতা স্বামী সহজানন্দ ভারত ছাড়োর সমর্থক ছিলেন না।
যুক্তপ্রদেশও এই আন্দোলনে শামিল হয়েছিল।
iv. মহারাষ্ট্র-কৰ্ণাটক
সীমান্ত :- বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে কৃষক আন্দোলন এই সময় গেরিলা যুদ্ধের আকার নিয়েছিল।
খান্দেশ, সাতারা অঞল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।
এ ছাড়া গুজরাটের সুরাট, খান্দেশ, ব্রোচ, জেলায় কৃষকেরা রেল অবরোধে অংশ নিয়েছিল।
উপসংহারঃ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কৃষকদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করা।
তবে কোথাও কোথাও তাদের মধ্যে জমিদার বিরোধিতা লক্ষ করা যায়।
কিছু অঞলের কৃষকেরা কিষান সভার নির্দেশ অমান্য করে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল।
কিষান সভা/নিখিল ভারত কিষান/ সারা ভারত কিষান সভা সম্পর্কে আলোচনা করো।
ভূমিকাঃ- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট ভাবধারার প্রভাবে ভারতের কৃষকশ্রেণি সাম্রাজ্যবাদী অপশাসনের বিরুদ্ধে ক্রমে সচেতন হয়ে ওঠে৷ এর পরিণতিতে 1936 খ্রিস্টাব্দে নিখিল ভারত কিষান সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। রুশ ঐতিহাসিক জি কতোভস্তি বলেছেন যে, ভারতের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে নিখিল ভারত কিষান সভার প্রতিষ্ঠা একটি স্মরণীয় ঘটনা।
প্রেক্ষাপটঃ- 1920 খ্রিস্টাব্দের অহিংস অসহযোগ
আন্দোলন এবং 1930 খ্রিস্টাব্দের আইন অমান্য আন্দোলনে কৃষকশ্রেণি যুক্ত হয়ে পড়ে।
তাদের সংগঠিত করে কৃষক আন্দোলন জোরদার করার উদ্দেশ্যে এই সময় জাতীয়তাবাদী,
বামপন্থী ও সমাজতান্ত্রিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে ওঠে।
এন জি রগ প্রমুখের
উদ্যোগঃ- প্রথমে
এন জি রঙ্গ এবং ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদ কিষান সভা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। তারা 1935
খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ভারতীয় কৃষক ও কৃষি-শ্রমিক যুগ্ম সংস্থা নামক কৃষকদের নিয়ে
একটি সংগঠন গড়ে তোলেন।
কিষান সভ্য
প্রতিষ্ঠাঃ- এরপর
1936 খ্রিস্টাব্দে নিখিল ভারত কিষান সভা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং উত্তরপ্রদেশের লক্ষ্ণৌ
শহরে এর প্রথম অধিবেশন বসে এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন বিহারের কৃষক নেতা স্বামী
সহজানন্দ সরস্বতী। কিষাণসভা প্রতিষ্ঠার
উদ্দেশ্য/ লক্ষঃ-
1. জমিদারি
প্রথা উচ্ছেদঃ-
জমিদারি প্রথা ছিল কৃষকদের দুর্দশার অন্যতম কারণ। তাই কিষান সভা জমিদারি প্রথার উচ্ছেদের
দাবি জানায়।
2. কৃষিঋণ
মকুবঃ- কৃষকরা ঋণ
নিয়ে অনন্তকাল ঋণের জালে জড়িয়ে থাকত। কিষান সভা এই ঋণ মকুবের দাবি জানায়।
3. বেগার
প্রথার অবসানঃ- জমিদারের
জমিতে কৃষকদের যে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে হত বেগার শ্রম দিতে হত, কিষাণসভা এই প্রথার
অবসানের দাবি করে।
4. খাজনা
হ্রাসঃ- কৃষকদের খাজনার
হার অন্তত 50 শতাংশ হ্রাস করার জন্য কিষান সভা দাবি জানায়।
5. বনজসম্পদে
অধিকারঃ- ইতিপূর্বে
ব্রিটিশ সরকার অরণ্য আইন পাস করে ভারতীয়দের অরণ্যের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। প্রকৃতির
বনজসম্পদ আহরণে কৃষকদের অধিকার দানের জন্য কৃষকসভা দাবি জানায়।
6. জমি
প্রদানঃ- সরকারের
অনাবাদী জমি এবং জমিদারের খাস জমি কৃষকদের হাতে প্রদানের জন্য কিষান সভা দাবি করে।
গুরুত্বঃ- নিখিল ভারত কিষান সভা প্রতিষ্ঠার
ফলে
a. কৃষকশ্রেণির ওপর শোষণের বিরুদ্ধে
কৃষকরা সচেতন হয়ে ওঠে।
b. ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে কৃষকরা
আরও বেশি সংখ্যায় যোগ দিতে থাকে।
টীকা লেখো বারদৌলি সত্যাগ্রহ।
ভূমিকাঃ-
গুজরাটের সুরাট
জেলার বারদৌলি তালুকের কৃষকরা 1928 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এক শক্তিশালী সত্যাগ্রহ
আন্দোলন শুরু করে, যা বারদৌলি সত্যাগ্রহ নামে পরিচিত। ‘
কারণ ও
প্রেক্ষাপটঃ- বারদৌলিতে সম্পন্ন কৃষকেরা কুনবি
পাতিদার নামে পরিচিত ছিল। এদের অধীনে জমি চাষ করত ঋণদাস নামে এক ধরনের দাস
শ্রমিক। এখানকার 60 শতাংশ মানুষ ছিল নিম্নবর্ণের কালিপারাজ বা কালো মানুষ। আর উচ্চবর্ণের মানুষেরা উজালিপারাজ বা সাদা মানুষ নামে পরিচিত
ছিল। ‘হালি’ প্রথা অনুসারে এখানকার
ভাগচাষিরা উচ্চবর্ণের মালিকদের অধীনে শ্রমিক হিসেবে কাজ করত।
খাজনা
বৃদ্ধিঃ- সরকার বারদৌলির কৃষকদের ওপরে 1927 খ্রিস্টাব্দে খাজনার হার 22 শতাংশ
বৃদ্ধি করে। ফলে কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়।
দুর্ভিক্ষঃ- 1925 খ্রিস্টাব্দে
বারদৌলিতে ভয়ানক বন্যা হয় ফলে কৃষকদের ফসল নষ্ট হওয়ায় সেখানে দুর্ভিক্ষের
পরিস্থিতি তৈরি হয়। ফলে কৃষকদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে।
নেতৃত্বঃ- বারদৌলি সত্যাগ্রহে নেতৃত্ব
দেওয়ার জন্য কৃষকরা গান্ধিবাদী কংগ্রেস নেতা বল্লভভাই প্যাটেলের সঙ্গে যোগাযোগ
করেন। তিনি এখানে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে অহিংস প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন। এছাড়া নরহরি
পারিখ, রবিশংকর ব্যাস, মোহনলাল পান্ডে প্রমুখ সর্দার প্যাটেলকে সহযোগিতা করেন।
মিঠুবেন প্যাটেল, মণিবেন প্যাটেল, সারদা মেহতা, ভক্তি বাঈ প্রমুখ নারী এই আন্দোলনে
সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
প্রভাবঃ- আন্দোলনের সমর্থনে বোম্বাই
বিধানসভার সদস্য কে এম মুন্সি ও লালজি নারাণজি পদত্যাগ করেন। গান্ধিজিও বারদৌলিতে
এসে আন্দোলনে নেতৃত্বদানের কথা ঘোষণা করেন। শেষপর্যন্ত সরকার নিযুক্ত এক কমিটি 6.03
শতাংশ খাজনা বৃদ্ধি অনুমোদন করলে কৃষকরা তা দিতে রাজি হয়।
উপসংহারঃ- সত্যাগ্রহ পদ্ধতিতে
সংগঠিত বারদৌলি সত্যাগ্রহ কৃষকদেরকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা
নিয়েছিল। গান্ধিজির সত্যাগ্রহ নীতি এখানে আর-একবার সফল বলে প্রমাণিত হয়। যখন
সরকার আন্দোলনের ফলে খাজনার হার 22 শতাংশ থেকে কমিয়ে 6.25 শতাংশ করে।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে বাংলার কৃষকরা কেন যোগদান করেনি?
অথবা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে বাংলার কৃষকরা কীরূপ ভূমিকা নিয়েছিল?
ভূমিকা : ভারতের বড়োলাট লর্ড কার্জন প্রশাসনিক সুবিধার অজুহাতে 1905 খ্রিস্টাব্দের 16 অক্টোবর বঙ্গদেশকে দুভাগে ভাগ করেন। এর বিরুদ্ধে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ছাড়াও সমগ্র দেশজুড়ে শুরু হয় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ‘বয়কট’ ও ‘স্বদেশি’ আন্দোলন। এতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করলেও কৃষকরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেনি।
কৃষকদের
সক্রিয়ভাবে অংশ
না নেওয়ার
কারণ:- ঐতিহাসিকগণ এই আন্দোলনে কৃষকদের সক্রিয় ও স্বতঃস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ না করার কতকগুলি কারণ তুলে ধরেছেন এগুলি নিম্নরূপ-
A.
কৃষিভিত্তিক
কর্মসূচির অভাব:-
ঐতিহাসিক সুমিত সরকার বলেন, সুনির্দিষ্ট কৃষিভিত্তিক কর্মসূচির অভাবজনিত কারণে এই আন্দোলনে কৃষকদের যুক্ত করা যায়নি।
প্রকৃতপক্ষে এই আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ কৃষকদের দুরবস্থার প্রতিকার, খাজনা বৃদ্ধি প্রতিরোধ, জমিদারদের অত্যাচার বন্ধের কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করেননি।
B.
জমিদারদের
ক্ষোভের আশঙ্কাঃ- কৃষকদের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল হলে এবং তাদের খাজনা বন্ধের দাবি মেনে নিলে দেশপ্রেমিক জমিদারশ্রেণি ক্ষুব্ধ হবেন।
এই আশঙ্কায় কংগ্রেসি নেতৃবৃন্দ এই আন্দোলনে কৃষকদের সামিল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেননি।
বরং জমিদার ঘেঁষা নীতিতেই আস্থা রেখে তাদের সন্তুষ্ট রাখতে প্রয়াসী হন।
C.
মধ্যবিত্তশ্রেণির
নেতৃত্বঃ- বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁরা উদীয়মান মধ্যবিত্তশ্রেণির প্রতিনিধি তাঁদের সঙ্গে গ্রামের কৃষকদের কোনো যোগ ছিল না।
গণআন্দোলনে কৃষকদের যে কোনো ভূমিকা থাকতে পারে তা তারা উপলব্ধি করেননি।
তাই ঐতিহাসিক ড. বিপানচন্দ্র বলেন, বঙ্গভঙ্গ বাংলার কৃষকদের স্পর্শ করেনি।
D.
মুসলিম
লিগের প্রভাবঃ- 1906 খ্রিস্টাব্দে নবাব সলিমউল্লাহের উদ্যোগে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লিগ’।
বড়োলাট লর্ড কার্জনের প্ররোচনায় তিনি বঙ্গভঙ্গ মেনে নেন।
ফলে নদিয়া, কুমিল্লা, মুরশিদাবাদ প্রভৃতি স্থানের মুসলমান কৃষকরা হিন্দু মহাজন ও জমিদারদের আক্রমণ করে।
ফলে এই পর্বে ওই অঞ্চলগুলিতে কৃষক আন্দোলন সাম্প্রদায়িক রূপ নেয়।
উপসংহারঃ-যাইহোক একথা ঠিক কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষে কৃষকশ্রেণিকে উপেক্ষা করে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ চরম অদুরর্শিতার পরিচয় দেন। ঐতিহাসিক সুমিত সরকার বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের অসাফল্য ও অস্থায়িত্বের জন্য
এই
আন্দোলনের
প্রতি কৃষক শ্রেণির অনীহার কথা বলেছেন।
ভূমিকাঃ-
গুজরাটের সুরাট
জেলার বারদৌলি তালুকের কৃষকরা 1928 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এক শক্তিশালী সত্যাগ্রহ
আন্দোলন শুরু করে, যা বারদৌলি সত্যাগ্রহ নামে পরিচিত। ‘
চরিত্রঃ-
1. সত্যাগ্রহ
আন্দোলনঃ- গান্ধির
সত্যাগ্রহের আদর্শে বারদৌলি সত্যাগ্রহ পরিচালিত হয়েছিল। যেসব কারণে এই আন্দোলনটিকে
সত্যাগ্রহ আন্দোলন বলা যায় সেগুলি হল
i.
এখানে
গান্ধিবাদী সত্যাগ্রহী নেতারা আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন।
ii.
সামাজিক
কর্মসূচির মধ্যে মদ্যপান, পণপ্রথা ও ‘হালি’ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচি
নেওয়া হয়েছিল। এই অঞলে সত্যাগ্রহ শিবির, বিদ্যালয় প্রভৃতি স্থাপন করা হয়েছিল।
2. কৃষক
আন্দোলনঃ-
আন্দোলনকারীদের অধিকাংশ ছিল কৃষক সম্প্রদায়ভুক্ত এবং তাদের দাবিদাওয়ার অধিকাংশ
ছিল কৃষি সংক্রান্ত। তাই কারও কারও মতে এই আন্দোলনকে কৃষক আন্দোলন বলা উচিত।
3. খাজনা
বিরোধী আন্দোলনঃ-
অতিরিক্ত খাজনা বৃদ্ধির প্রতিবাদে এখানে আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল এবং কৃষকেরা এর
প্রতিবাদে খাজনা প্রদান বন্ধ করে দিয়েছিল। তাই একে খাজনা বিরোধী আন্দোলন বলা
উচিত।
4.
নারীদের আংশগ্রহণঃ- এই আন্দোলনে বহু নারী অংশগ্রহণ
করেন। তাদের মধ্যে মিঠুবেন প্যাটেল, মনিবেন প্যাটেল, সারদা মেহতা, ভক্তবাই প্রমুখর
নাম উল্লেখযোগ্য।
5. নিম্নবর্গীয় মানুষদের আন্দোলনঃ- ঐতিহাসিক ডি. এন. ধনাগারে বলেছেন যে, এই আন্দোলন জমির মালিকদের শোষণের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়ে উচ্চবর্ণের পতিদারদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল।
উপসংহারঃ- বারদৌলি আন্দোলনের চরিত্র সম্পর্কে
বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন প্রকার অভিমত ব্যক্ত করলেও, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের
নেতৃত্বে সংঘটিত এই বিদ্রোহমূলত সত্যাগ্রহ পদ্ধতিতেই পরিচালিত হয়েছিল।