একাদশ শ্রেণীর দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রশ্ন উত্তর নাম্বার 19
একাদশ শ্রেণীর দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রশ্ন উত্তর নাম্বার 19 |
হরপ্পা সভ্যতার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও অথবা প্রবন্ধ লেখো-হরপ্পা সভ্যত?
ভূমিকা : ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে সিন্ধু অববাহিকা অঞ্চলে তাম্র-ব্রোঞ্জ যুগে এক সুপ্রাচীন উন্মেষ হয়—যা ইতিহাসে হরপ্পা সভ্যতা নামে পরিচিত। এই সভ্যতা ছিল সুপ্রাচীন মিশরীয় ও সুমেরীয় সভ্যতার সমসামৰিাক। অভিনবত্বে, উৎকর্যে ও মৌলিকত্বে এই সভ্যতা যে-কোনাে প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে তুলনীয়।
আবিস্কার : 1921 খ্রিস্টাব্দে দয়ারাম সাহানি পঞ্জাবের মন্টগােমারী জেলায় ' ইরাবতী নদীর তীরে হরপ্পা নগর সত্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করেন। এরপর 1922 খ্রিস্টাব্দে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সিন্ধুপ্রদেশের লারকানা জেলায় মহেনজোদারাে নামক স্থানে একটি উন্নত নগরকেন্দ্রিক সত্যতা আবিষ্কার করেন।
নামকরণ : সিন্ধু নদীর অববাহিকা অঞ্চলে এই সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল বলে তৎকালীন ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধিকর্তা জন মার্শাল এই সভ্যতার নাম দেন সিন্ধু সভ্যতা। কিন্তু পরবর্তীকালে এই সভ্যতার নামকরণ করা হয় হরপ্পা সভ্যতা। কারণ i. হরপ্পা প্রথমে আবিষ্কৃত হয়, ii. হরপ্পা এই সভ্যতার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত, iii. মহেনজোদারাে অপেক্ষা হরপ্পায় প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রী বেশি প্রাচীন ও গুরুত্ব বেশি।
প্রধান প্রধান কেন্দ্র : বর্তমানে হরপ্পা সভ্যতার 1500টি কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এই কেন্দ্রগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযােগ্য হল—হরপ্পা, মহেনজোদারাে, চানহুনদারাে, রূপার, লােথাল, আলমগিরপুর, কালিবগান, বানওয়ালি, রংপুর, কোটদিজি প্রভৃতি।
বিস্তৃতি : সিন্ধু তীরবর্তী অঞ্চল অতিক্রম করে এক বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল—উত্তরে জম্মুর মান্ডা থেকে দক্ষিণে গােদাবরী উপত্যকার দাইমাবাদ এবং পশ্চিমে ইরান-পাকিস্তান সীমান্তে সুকাজেনদারে থেকে পূর্বে উত্তরপ্রদেশের আলমগিরপুর। এর আয়তন 12 লক্ষ 50 হাজার বর্গমাইল।
প্রাচীনত্ব : হরপ্পা সভ্যতার কালসীমা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার না হওয়ার ফলে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ওপর ভিত্তি করে কালসীমা নির্ধারণ করা হয়।
i. জন মার্শাল এই সভ্যতার অন্যতম আবিষ্কারক। তাঁর মতে এই সভ্যতার সময়সীমা 3250 BC থেকে 2750 BC পর্যন্ত।
ii. মর্টিমার হুইলার ও স্টুয়ার্ট পিগটের মতে হরপ্পা সভ্যতার কালসীমা 2350 BC থেকে 1500 BC পর্যন্ত।
iii. সি. জে. গ্যাডের মতে হরপ্পা সভ্যতার সময়সীমা হল 2350 BC থেকে 1770 BC পর্যন্ত।
iv. অলচিন দম্পতির মতে হরপ্পা সভ্যতার সময়কাল ছিল। তার। 2100 BC থেকে 1700 BC পর্যন্ত। iv. ড. ফ্রাঙ্ক ফোর্ট তা সিন্ধু সভ্যতার বারােটি সিল পরীক্ষা করে সময়কাল নির্ধারণ করে 2800 BC স্থির করেছেন। vi. রেডিয়াে-কার্বন-14 বর। পরীক্ষায় হরপ্পা সভ্যতার সময়কাল 2000 BC থেকে 1500 পুর। BC নির্ধারিত হয়েছে। উপরােক্ত আলােচনার পর দেখা যাচ্ছে। ব্দ যে হরপ্পার ঊর্ধ্বতন সময়সীমা হল 2800 BC, তার সঙ্গে 500 বছর সুপ্ত ছিল অর্থাৎ মােট 2800 + 500 = 3300 BC অর্থাৎ, নিম্নতম কালসীমা 1500 BC।
নির্মাতা : হরপ্পা সভ্যতা কারা নির্মাণ করেছে তা নিয়েও বিতর্ক আছে। হরপ্পা সভ্যতার নরকঙ্কাল পরীক্ষা করে প্রােটো । অস্ট্রালয়েড, ভূমধ্যসাগরীয়, মােঙ্গলীয়, আল্পে-দিনারিক প্রভৃতি বিভিন্ন জনগােষ্ঠীর পরিচয় পাওয়া গেছে। i. গর্ডন চাইল্ড ও মর্টিমার হুইলার-এর মতে সুমেরীয়রা হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা। ii. ড. সুনীতি চট্টরাজ ও ডঃ ব্যাসাম-এর মতে দ্রাবিড়রা হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা। ii. এ. ডি. পুসলকার ও অলচিন দম্পতির | মতে হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা আর্যরা। যতদিন না সিন্ধু লিপি পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে ততদিন জানা যাবে না যে কারা হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা।
নগর সভ্যতা : চওড়া প্রশস্ত রাজপথ, উন্নত পয়ঃপ্রণালী, পােড়া ইটের তৈরি ঘরবাড়ি, স্নানাগার, শস্যাগার হরপ্পার নগর সভ্যতার পরিচয় বহন করে। প্রতিটি কেন্দ্রেই নগরের ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন পাওয়া গেছে। একইভাবে নগরগুলির বারবার নির্মাণ, উন্নত কঠোর পৌরশাসনের ইঙ্গিত দেয়। 0 খাদ্য : হরপ্পা সভ্যতার মানুষের প্রধান খাদ্য ছিল। গম, যব, ফলমূল, বার্লি, খেজুর, বাদাম, শাকসবজি, ভাত, মাছ, ডিম, মুরগি, ভেড়া, গােরু ও বিভিন্ন পশুপাখির মাংস। পােশাক : হরপ্পা সভ্যতার মানুষেরা দু-খণ্ডবিশিষ্ট সুতি বা পশমবস্ত্র ব্যবহার করত। নারী-পুরুষ উভয়ে লম্বা চুল রাখত এবং সােনা, রুপা, পাথরের তৈরি হার, দুল, আংটি, কোমরবন্ধ প্রভৃতি অলংকার পরত।
জীবিকা : হরপ্পা সভ্যতার মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল। কৃষি, পশুপালন, শিল্প ও বাণিজ্য। বেশিরভাগ মানুষের জীবিকা ছিল কৃষি। যব, গম, বার্লি, খেজুর, তিল, রাই ছিল প্রধান কৃষিজাত ফসল। গৃহপালিত পশুদের মধ্যে ছিল গােরু, মহিষ, ভেড়া, উট, শূকর, ছাগল প্রভৃতি। সুমের, আক্কাদ প্রভৃতি দেশের সঙ্গে এদের বৈদেশিক বাণিজ্য চলত।
হাতিয়ার : হরপ্পা সভ্যতার মানুষ লােহার ব্যবহার জানত। তারা পাথর, তামা ও ব্রোঞ্জ দিয়ে বিভিন্ন হাতিয়ার ও প্রয়ােজনীয় সামগ্রী তৈরি করত। বর্শা, কুঠার, তিরধনুক প্রভৃতি অস্ত্র ব্যবহার করত।
বিনােদন : নৃত্য-গীত, পশুশিকার, পাশাখেলা, যাঁড়ের লড়াই, রথ চালনা প্রভৃতি ছিল তাদের অবসর বিনােদনের মাধ্যম।
ধর্মবিশ্বাস : হরপ্পাবাসী গাছ, পাথর, আগুন, জল, সাপ প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তি ও জীবজন্তুকে পূজা করত। একটি সিলে তিনটি মাথাবিশিষ্ট ধ্যানমগ্ন পশুবেষ্টিত এক যােগী পুরুষের মূর্তি পাওয়া গেছে। একে অনেকে আদি শিব বলেন।এ ছাড়া তারা মাতৃপূজা করত ও সূর্যের উপাসনা করত।
পতন : হরপ্পা সভ্যতার পতনের কারণও রহস্যাবৃত। বন্যা, ভূমিকম্প প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈদেশিক আক্রমণ প্রভৃতি কারণগুলিকে এই সভ্যতার পতনের। জন্য দায়ী করা হয়।