ভিয়েনা সম্মেলন (1815 খ্রি., Congress of Vienna) সম্পর্কে আলোচনা কর। অথবা, ভিয়েনা সম্মেলন বলতে কী বোঝায়? এই সম্মেলনে কারা যোগদান করেছিলেন? ভিয়েনা সম্মেলনের উদ্দেশ্য কী ছিল ? ভিয়েনা সম্মেলনের (1815 খ্রি., Congress of Vienna) কার্যকাল সম্পর্কে আলোচনা করো। অথবা, ভিয়েলা সম্মেলনে গৃহীত ন্যায্য অধিকার, ক্ষতিপূরণ ও শক্তিসাম্য নীতি সম্পর্কে আলোচনা করো। এই নীতিগলি কি ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ বজায় রেখেছিল ?


ভিয়েনা সম্মেলন (1815 খ্রি., Congress of Vienna) সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, ভিয়েনা সম্মেলন বলতে কী বোঝায়? এই সম্মেলনে কারা যোগদান করেছিলেন?
ভিয়েনা সম্মেলনের উদ্দেশ্য কী ছিল ?
 
ভিয়েনা সম্মেলন
ভূমিকা:- নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ফ্রান্সের ক্ষমতা দখল করার পর এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি একের পর এক যুদ্ধে জয়লাভ করে ইউরোপের রাজনৈতিক মানচিত্র ওলটপালট করে দিয়েছিলেন। এই পরিবর্তন ইউরোপের রাজারা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেননি। তাই নেপোলিয়নের পতনের পর 1815 খ্রিস্টাব্দে তারা ইউরোপীয় রাজ্যগুলির পুনর্গঠন, পুনর্বিন্যাস ও সেখানে উদ্ভূত নানা সমস্যার সমাধানের জন্য অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে সমবেত হন। একে ‘ভিয়েনা সম্মেলন’ বলা হয়।

ভিয়েন সম্মেলনে যোগদানকারী:- পোপও তুরস্কের সুলতান ছাড়া ইউরোপের সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা ভিয়েনা সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাজা, রাজনীতিজ্ঞ ও সাংবাদিকদের উপস্থিতির ফলে ভিয়েনা সম্মেলন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পরিণত হয়েছিল।
এই সম্মেলনে যোগদানকারী ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য  ছিলেন—
সমসাময়িক প্রধান তিন রাজাঃ-
a.       প্রথম ফ্রান্সিস (অস্ট্রিয়া)
b.      প্রথম আলেকজান্ডার (রাশিয়া)
c.       তৃতীয় ফ্রেডরিক উইলিয়ম (প্রাশিয়া)
উপস্থিত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি, মন্ত্রী-কূটনীতিজ্ঞদে মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন :  অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী
ক্লেমেন্স ভন মেটারনিখ, ইংল্যান্ডের রাজপ্রতিনিধি ডিউক অফ ওয়েলিংটন, ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী: ক্যাসালরি (Castlereagh),প্রাশিয়ার মন্ত্রী হার্ডেনবার্গ, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নেসেলরোড এবং ফ্রান্সের প্রতিনিধি টেলির‍্যান্ড।
চার প্রধান (Big Four): ভিয়েনা সম্মেলনে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকলেও নেপোলিয়নের পতনে বিশিষ্ ভূমিকা গ্রহণকারী চারটি রাষ্ট্র ছিল প্রধান। এগুলি হল—অস্ট্রিয়া,  রাশিয়া,  ইংল্যান্ড ও প্রাশিয়া। ভিয়েনা সম্মেলনে এই চারটি শক্তি চার প্রধান বা Big Four নামে পরিচিত।
প্রধান ব্যক্তিত্ব:- সম্মেলনে যোগদানকারী প্রধান ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন- অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স মেটারনিখ, রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার, ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ক্যালরি এবং ও পরাজিত ফ্রান্সের প্রতিনিধি টেলির‍্যাণ্ড
সম্মেলনের সভাপতি:- ভিয়েনা সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স ক্লেমেন্স ভন মেটারনিখ। তিনি ছিলেন এই সম্মেলনের সর্বাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ও মূল নিয়ন্ত্রক। তিনি নিজেকে বিজয়ীর বিজয়ী’ (Conqueror of Conquerors) বলে মনে করতেন।
সম্মেলনের সমস্যাঃ- ভিয়েনা সম্মেলনের প্রতিনিধিদের সামনে অনেক সমস্যা ছিল। যেমন—
a.       নেপোলিয়নের আগ্রাসনের ফলে ইউরোপে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছিল তার পুনর্গঠন করা।
b.      ফ্রান্স পুনরায় যাতে ইউরোপের শান্তি বিঘ্নিত করতে না পারে তার ব্যবস্থা করা।
c.       নেপোলিয়ন কর্তৃক বিতাড়িত রাজবংশগুলির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। পোল্যান্ড, ইটালি, জার্মানি, ব্যাভেরিয়া, স্যাক্সনি, রাইন অঞল প্রভৃতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা।
ভিয়েনা সম্মেলনের উদ্দেশ্য :-
ঘোষিত উদেশ্যঃ- ভিয়েনা সম্মেলনে ঘোষিত উদ্দেশ্যগুলি ছিল-
a.       ইউরোপে নিরবচ্ছিন্ন স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা।
b.      ন্যায় ও সততার ভিত্তিতে ইউরোপের পুনর্গঠন।
c.       রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও সৌভ্রাতৃত্ব স্থাপন প্রভৃতি।
প্রকৃত উদ্দেশ্যঃ- ভিয়েনা সম্মেলনে উচ্চ আদর্শের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হলেও সম্মেলনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল—
a.       ফরাসি বিপ্লবের উদারনৈতিক ভাবধারা দমন করে ইউরোপে পুরাতনতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
b.      নেপোলিয়নকে পরাজিত করতে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল আত্মসাৎ করা।
ভিয়েনা সম্মেলনের মুল নীতিঃ-  ভিয়েনা সম্মেলনের নেতৃবৃন্দ ইউরোপের পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে তিনটি মূল নীতি গ্রহণ করেছিলেন—
a.       ন্যায্য অধিকার নীতি,
b.      ক্ষতিপূরণ নীতি ও
c.        শক্তিসাম্য নীতি।
মূল্যায়নঃ- আধুনিক ইউরোপের ইতিহাসে ভিয়েনা সম্মেলন একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হলেও তা বিভিন্নভাবে সমালোচিতও হয়েছে। তবে নানা ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলেও এর গুরুত্বকে স্বীকার করতেই হয়। ঐতিহাসিক ডেভিড থমসন (David Thomson) বলেছেন যে, ভিয়েনা সম্মেলন পরবর্তী প্রায় 40 বছর ইউরোপে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল।

 ভিয়েনা সম্মেলনের (1815 খ্রি., Congress of Vienna) কার্যকাল সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা, ভিয়েলা সম্মেলনে গৃহীত ন্যায্য অধিকার, ক্ষতিপূরণ ও শক্তিসাম্য নীতি সম্পর্কে আলোচনা করো। এই নীতিগলি কি ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ বজায় রেখেছিল ?

নেপোলিয়নের পতনের পর ইউরোপীয় শক্তিবর্গ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা শহরে এক সম্মেলনে সমবেত হন। এই সম্মেলন চলেছিল 1814 খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর থেকে 1815 খ্রিস্টাব্দের জুন মাস পর্যন্ত। একেভিয়েনা সম্মেলন বলা হয়। পোপ ও তুরস্কের সুলতান ছাড়া ইউরোপের সব দেশের রাষ্ট্রনেতারা সম্মেলনে যোগ দেন। এই সম্মেলন ছিল ইউরোপ তথা বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন।
ভিয়েনা সম্মেলনে গ্রহীত নীতি:- ভিয়েনা সম্মেলনে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর তিনটি নীতি গ্রহণ করা হয়। এই তিনটি নীতি হল-
a.      ন্যায্য অধিকার নীতি
b.      ক্ষতিপূরণ নীতি ও
c.       শক্তিসাম্য নীতি
এই নীতিগুলির উপর ভিত্তি করে সম্মেলনের কার্যকলাপ পরিচালিত হয়।
a.   ন্যায্য অধিকার নীতি:-ন্যায্য অধিকার নীতিতে বলা হয়, ফরাসি বিপ্লবের আগে যে রাজা বা রাজবংশ যে দেশে রাজত্ব করতেন, সেখানে সেই রাজার বা রাজবংশের আবার রাজত্ব করার অধিকার আছে। এই নীতি অনুসারে
                                                  i.      ফ্রান্সে বুরবো বংশের শাসক অষ্টাদশ লুই সিংহাসনে বসেন।
                                                ii.      স্পেন, সিসিলি ও নেপলসেও বুরবো বংশের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
                                              iii.      অস্ট্রিয়ায় হ্যাপসবার্গ বংশ তাদের রাজত্ব ফিরে পায়।
                                              iv.      হল্যান্ডে অরেঞ্জ বংশ এবং স্যাভয়, জেনোয়া, পিডমন্ট ও সার্ডিনিয়ায় স্যাভয় বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
b.   ক্ষতিপূরণ নীতিঃ- নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ভিয়েনা সম্মেলনে তারা নিজেদের ক্ষতিপূরণ করে নেওয়ার জন্য যে নীতি গ্রহণ করেছিল, তা ক্ষতিপুরণ নীতি নামে পরিচিত। যে সব দেশ নেপালিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সেগুলি হল ইংল্যান্ড, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, সুইডেন প্রভৃতি। ক্ষতিপূরণ নীতি অনুসারে এই দেশগুলি যেভাবে উপকৃত হয়, তা নিম্নরূপ-
অস্ট্রিয়াঃ- অস্ট্রিয়া উত্তর ইতালিতে পায় লম্বাডি, ভেনেসিয়া, টাইরল প্রভৃতি প্রদেশ। মধ্য ইটালিতে পার্মা, মডেনা ও টাসকানির উপর অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ বংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অস্ট্রিয়া নবগঠিত জামান কনফেডারেশনের সভাপতির পদ লাভ করে।
রাশিয়াঃ- রাশিয়া পায় পোল্যান্ডের বৃহদংশ, ফিনল্যান্ড ও তুরস্কের বেসারাভিয়া।
প্ৰাশিয়াঃ- প্রাশিয়া পায় স্যাক্সনির উত্তরাংশ, পোজেন, থর্ন, ডানজিগ, পশ্চিম পোমেরানিয়া ও রাইন নদীর বাম তীরবর্তী অঞ্চল।
ইংল্যান্ডঃ- ইংল্যান্ড ঔপনিবেশিক স্বার্থে ক্ষতিপূরণ হিসেবে নেয় ভূমধ্যসাগরের মাল্টা দ্বীপ, মরিসাস, হেলিগোল্যান্ড, সিংহল প্রভৃতি।
c.    শক্তিসাম্য নীতিঃ- ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত শক্তিসাম্য নীতি বলতে বোঝায় ফ্রান্সের শক্তি খর্ব করে সমতা তৈরি করা, ফ্রান্স যাতে শক্তিশালী হয়ে ইউরোপের শান্তি বিঘ্নিত করতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। এই নীতি অনুসারে-
                                                i.   ফ্রান্সকে বিপ্লব পূর্ববর্তী সীমানায় ফিরিয়ে আনা হয়।
                                              ii.   ফ্রান্সের সেনাবাহিনী ভেঙে দেওয়া হয়। 5 বছরের জন্য ফ্রান্সে মিত্রপক্ষের সেনা মোতায়েন রাখার ব্যবস্থা করা হয়।
                                            iii.   মিত্রপক্ষের এই সেনাবাহিনীর ব্যয়ভার ফ্রান্সকে বহন করতে হয়।
                                            iv.   মিত্রপক্ষকে 70 কোটি ফ্রাঙ্ক ক্ষতিপূরণ দিতে ফ্লান্সকে বাধ্য করা হয়।
   ফ্রান্সের চারপাশে'শক্তিশালী রাষ্ট্রবেষ্টনী গড়ে তোলা হয়।
                                                i.   ফ্রান্সের পূর্বসীমান্তে রাইন অঞ্চলকে প্রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
                                              ii.   ফ্রান্সের উত্তর-পূর্বেলুক্সেমবুর্গ ও বেলজিয়ামকে হল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
                                            iii.   ফ্রান্সের দক্ষিণে স্যাভয় ও জেনোয়াকে সার্ডিনিয়ার সঙ্গে এবং
                                            iv.   ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্বে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে কয়েকটি অঞ্চল যুক্ত করা হয়। সুইজারল্যান্ডকে ‘নিরপেক্ষ দেশ’ বলে ঘোষণা করা হয়।
ভিয়েনা সম্মেলনের নীতি ও ফরাসি বিপ্লবের আদর্শঃ- ভিয়েনা সম্মেলনের নেতৃবৃন্দ ন্যায্য অধিকার ও ক্ষতিপূরণ নীতি প্রয়োগ করে ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত জাতীয়তাবাদের চরম অবমাননা করেছিলেন। জার্মানি ও ইটালির রাজ্যগুলিকে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় রাষ্ট্রে পরিণত না করে পুনরায় স্বৈরতন্ত্রী অস্ট্রিয়া বা প্রাশিয়ার অধীনে স্থাপন করা হয়েছিল। এ ছাড়া শক্তিসাম্য নীতিকে কার্যকর করতে গিয়ে সম্মেলনের আয়োজকরা ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত ভাবাদর্শকে বিসর্জন দিয়েছিলেন।
 
পোস্ট টি পড়ার জন্য ধন্যবাদ ভাল লেগে থাকলে অবশ্যই অন্যদের শেয়ার কর

Next Post Previous Post
3 Comments
  • CB Sayan
    CB Sayan ২৯ আগস্ট, ২০২০ এ ১০:০০ AM

    Very helpful

  • নামহীন
    নামহীন ৪ মে, ২০২২ এ ১০:৩৭ AM

    helpful for me and my class friends ❤️🥰my friends and I wrote this all in my school's project .

  • নামহীন
    নামহীন ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ এ ১২:৫৫ PM

    ভিয়েনা সম্মেলনে প্রাশিয়ার প্রতিনিধি কে ছিলেন

Add Comment
comment url